আমাদের শিশুসাহিত্য এবং এ প্রজন্মের বইপাঠ

মনোবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, শিশুদের বয়স দুভাগে বিভক্ত। একটি হলো জন্ম থেকে ছয় বছর বয়স এবং আরেকটি হলো ছয় থেকে চৌদ্দ বছর। বয়সের এ দু-অংশ মিলেই শৈশব। এই শৈশব নামক রঙের দুনিয়া লাল-নীল জিগজ্যাগ বাতির মতোই।

আলো ছড়িয়ে ভরিয়ে রাখে ছোট্ট হৃদয় ও মন। এই বয়সে মনে কোনো ক্লেদ থাকে না। লেদ মেশিনে পলিশ করে দেওয়া থাকে চিন্তার জগৎ। কোনো পাপ এসে গ্রাস করে না শিশুর ছোট্ট হৃদয়; মেঘমুক্ত শিশুমন অপার অসীম উজ্জ্বলতায় কল্পনার রাজ্যে ভাসতে থাকে সারাক্ষণ। বিশেষ করে শিশুরা এ সময়ে মন্দ-ভালোর বিভাজন করতে পারে না। শিশুমন হয় কোমলমতি। তার মন ও মানসে সর্বদা বিরাজ করে নিরেট সরলতা। একটা সাদা খাতার মতোই এই মন ঝকঝকে পরিষ্কার। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘শিশু প্রকৃতির সৃজন’।

কিন্তু তারা বড়দের দেখে শেখে। বড়দের আচরণ, অভিব্যক্তি দেখে বা শুনে শিশুরা দ্রুত তা আত্মস্থ করতে পারে। এ কারণে শিশুদের সঙ্গে বড়দের আচরণ ও ব্যবহার এবং তাদের শিক্ষাপ্রদানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট যত্নশীল হতে হয়।

শিশুমনের সাদা খাতা সৃজনের তুলিতে অংকিত করেন মা, তিনিই শিশুর প্রথম শিক্ষক। বাবাসহ পরিবারের অন্য সদস্য এবং সর্বোপরি একজন লেখকেরও রয়েছে এরপরের দায়িত্ব। সুপ্রাচীন কাল থেকেই লেখকেরা সেই মহান দায়িত্ব পালন করে আসছেন অত্যন্ত সৎ থেকে, নিষ্ঠার সঙ্গে। শিশুদের প্রকৃতি, মন-মেজাজ, আচরণ, কৌতূহল, আগ্রহ ইত্যাদি বিষয় খেয়াল রেখেই লেখকেরা লিখে যাচ্ছেন শিশুর জন্য সাহিত্য। একজন শিশুসাহিত্যিক মানবপ্রকৃতি, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং শিশুদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানার্জন করেই লিখতে বসেন। বয়স বিবেচনায় নিয়ে লিখে যান মনন ও সৃজন বিকশিত রচনা। 

বাংলা ভাষায় শিশুসাহিত্য রচনা শুরু হয় ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত নীতিকথা নামক গ্রন্থের মাধ্যমে।

দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, স্বর্ণকুমারী দেবী প্রমুখের রচনার মধ্য দিয়ে। 

তৃতীয় পর্যায় অর্থাৎ এর পর রবীন্দ্রযুগ। শিশুসাহিত্য হয়ে ওঠে আনন্দদায়ক। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, কাজী নজরুল ইসলাম, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমেন্দ্রপ্রসাদ, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সুখলতা রাও, মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী, হাবিবুর রহমান, ইমদাদুল হক, ইবরাহীম খাঁ, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, বন্দে আলী মিয়া, মোহাম্মদ মোদাব্বের, হবীবুল্লাহ বাহার, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, কাজী কাদের নেওয়াজ, ফররুখ আহমদ, মোহাম্মদ নাসির আলী, শওকত ওসমান, আতোয়ার রহমান, হাবিবুর রহমান, জসীম উদ্দীন প্রমুখ বাংলার শিশুসাহিত্য সমৃদ্ধ করেছেন। বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ রচনা করে আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আশ্রাফ সিদ্দিকী, রোকনুজ্জামান খান, মাহবুব তালুকদার, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হুমায়ূন আহমেদ প্রমুখের হাত ধরে বাংলা শিশুসাহিত্য পেয়েছে বিশেষ গতি।

কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষ আর নব-নব আবিষ্কার পৃথিবীবাসীকে যেমন নতুন জীবন দিয়েছে, তেমনি এই প্রজন্মকে করে তুলেছে যন্ত্রনির্ভর। ব্যাপারটা এত দ্রুতগতিতে ঘটে যাচ্ছে যে, আমাদের শিশুসাহিত্যিকরা এই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারছেন কমই। প্রযুক্তির আধুনিকায়নের ফলাফল এত দ্রুতগতিতে ঘটছে যে, আগামী প্রজন্ম আরও কতদূর এগিয়ে যাবে, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। কিন্তু শিশুসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে এই প্রজন্মের মেজাজ, কৌতূহল, শখ, আগ্রহ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে লেখকের ঘাটতি থাকায় শিশুদের মধ্যে বই-পাঠাভ্যাস খুব দ্রুততার সঙ্গে কমে যাচ্ছে। শিশু হয়ে উঠছে বইসঙ্গ-বিমুখ। ফলে শিশুমনের জাদুর পৃথিবীটা একটি একটি করে হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ আমরা চাই, আজকের শিশু অবিরাম আনন্দে ঘুরে বেড়াক লাগামহীন টাট্টু ঘোড়ার পিঠে। তারা নতুন দিগন্তের সন্ধান করুক। আহা, তারা যেন বইমুখী হয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //