ক্লাউস হার্পপ্রেখ্টের (১৯২৭-২০১৬) জন্ম জার্মানির স্টুটগার্টে। সাংবাদিক, লেখক ও পরিচালক হিসেবে তিন জায়গাতেই বেশ সফলতা অর্জন করেন। তার উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে ; স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা (Die Lust der Freiheit), প্যারিসে জার্মান বিপ্লবীরা (Deutsche Revolutinäre in Paris) (এটি মূলত একটি উপন্যাস), থমাস মান (Thomas Mann) (এটি নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক থমাস মানের জীবনী), স্বাচ্ছন্দ্যের শেষে: অস্ট্রিয়ার ডায়েরি (Am Ende der Gemütlichkeit: Ein österreichisches Tagebuch) ইত্যাদি। ভাষান্তর : তানিম নওশাদ।
ছোটবেলায় কস্মিনকালেও একটি ইহুদি চোখে পড়েনি। নাকি কথাটি ঠিক না? কোথায় জেনেছিলাম, মানুষ ইহুদিকে ইহুদি হিসেবেই চিনবে? সূত্রপাতটা কি তবে এভাবেই? আমার বোধবুদ্ধি কি আমার শিশু অন্তরে সেই বিদ্বেষপূর্ণ চিত্রের কারণে আলোড়ন তুলত না? প্রতিটি পোস্টারের দেয়াল, প্রতিটি ম্যাগাজিন ও প্রতিটি সংবাদপত্র বাঁকানো নাক ও বাঁকা পায়ের মানুষের লজ্জাদায়ক চিত্রে পরিপূর্ণ থাকত। আর এই গতানুগতিক চিত্রগুলো আমাদের স্কুলের পাঠ্য বইয়ের শুরুতেও দৃশ্যমান ছিল।
পাদ্রিবাড়ির পাশেই আমি বেড়ে উঠেছিলাম। শহরের ব্যান্ডপার্টির মাস্টারের সঙ্গে কথা হতো, যিনি শনিবার সন্ধ্যায় মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে থাকতেন। কথা হতো তার বাদ্যযন্ত্রের দোকানে বসেই। তার প্রতিবেশী ছিলেন জনাব নাপিত। কখনোসখনো আমি ছোট্ট চেয়ারটায় বসে হেলান দিতাম, অপেক্ষমাণ থাকতাম সেইসব প্রকট কেশবিন্যাস দেখবার জন্য : ‘ঈশ্বরের দিব্যি, কোনোভাবেই চুলের ছাঁট যেন বিশ্রী না হয়;’ বলেই তারপর ব্যান্ড মাস্টার নিজেই কাঁচিটা নিয়ে তাতে ক্যাঁচর-ম্যাচর আওয়াজ তুলতেন।
আমি ক্রেতাদের জন্য ঝুলানো পত্রিকাগুলোর কোনো একটা হাতে নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টে যেতাম আর দেখতাম ক্যারিকেচারগুলো। ইহুদিদের কথা মনে করিয়ে দিত পাশে উপবিষ্ট ব্যান্ড মাস্টার, যিনি প্রাশিয়ান মার্চপাস্ট আর ফুয়েরারের ঝড়োবাহিনীগুলোর (জার্মানে Strurm-Abteilungen) সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছোট ছোট হাতকে শূন্যে ভাসিয়ে সুর নির্দেশনা দিতেন। আর এই সবই ছিল আমার জন্য এক হাসির খোরাক।
হঠাৎ হঠাৎ বাবা এসে উপস্থিত হতেন দোকানে। আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ছুড়ে ফেলতেন। আর আমি আমার হাত দিয়ে মুখ সামলানোর আগেই খেতাম বেমক্কা এক ঘুষি। ‘এসব গু-মুত তুই হাতে নিবি না!’-চিৎকার করে উঠতেন বাবা। এই পত্রিকার নাম ছিল প্রলয়ঙ্করী (জার্মানে Stürmer), আর তা প্রকাশ করতেন ইউলিয়াস স্ট্রাইখার, যিনি ছিলেন ফ্রাঙ্কোনীয় অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান। সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি অন্তরে লালন করতেন ইহুদি জাতির প্রতি অপরিসীম ঘৃণা। এই লোক মস্তিষ্ক-বিকৃতিতে আক্রান্ত ছিলেন। দেখতেও তিনি উত্তরের উন্নত জাতিগুলোর মতো ছিলেন না; কিন্তু পার্টির সকলেই সে হাইনরিখ হিমলার হোক বা ইয়োসেফ গোয়েবল্স-প্রত্যেকেই নিজেকে উন্নত জাতির এক একটি সংস্করণ বলে মনে করতেন। বাবা প্রায়ই বলতেন যে, নেতাদের উচিত আয়নায় একবার নিজের বদনটা দেখার; অন্তত জাতি বিষয়ক শিক্ষাটা মনে করতে হলেও।
না, কোনো ইহুদিকেই আমি চিনতাম না। আমার বয়স তখন ছিল দশ বছর। তিন-চার বছর পর যুদ্ধ শুরু হলো। আমাদের এই ছোট্ট দেশটার রাজধানীতে বিশেষত থিয়েটার, অপেরা কিংবা কনসার্টে আমি তখন ঘুরে বেড়াতাম।
একবার রাতের বেলা এক বিপণির শোরুমের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখলাম অপরূপা নারীদের, যারা তাদের নগ্নবক্ষের শোভা দিয়ে ঘরটাকে বিভাময় করে রেখেছে। যখন আমি মাথা তুললাম, দেখলাম এক নারীকে; সে আমার পাশেই এসে দাঁড়াল। সে তখন বিধ্বস্ত, মুখভঙ্গি সন্দেহবশত সঙ্কুচিত, সেই সঙ্গে দুচোখই তার বিস্ফারিত। আমাদের দৃষ্টি বিনিময় হলো কয়েক মুহূর্ত মাত্র। আর তাতে তার ভেতরকার প্রশ্নময় ভীতি আমি উপলব্ধি করতে পারলাম। সে হঠাৎই আমার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে চলে গেল। সে বহন করছিল সেই হলুদ রঙের তারা।
[জার্মান নাৎসি বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে থেকেই ইহুদিদের শনাক্ত করতে হলুদ রঙের তারা সঙ্গে বহন করতে বাধ্য করেছিল।]
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh