Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

নজরুলের কবিতায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৪, ১৭:১৭

নজরুলের কবিতায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

নজরুলের কবিতা রাজনৈতিক চেতনায় এতোটাই ঋদ্ধ যে সামাজিক সময় ও তৎকালীন সময়কে তিনি তার সাহিত্যে স্থান করে দিয়েছে। সাহিত্য যে সমাজ- ও সময়ের বাস্তবিকতার প্রতিনিধিত্ব করে নজরুলের কবিতা সেই সমাজবাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে।  প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি ছিলো একদম আলাদা। পৃথিবীব্যাপী  অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মূল্যবোধের ভয়াবহ অবক্ষয়, পৃথিবীব্যাপী যে অস্থিরতা- তার মধ্যে  বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে ১৯১৭ সালে মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে সংঘটিত রুশ বিপ্লব। সারা বিশ্ব যেন রুশ বিপ্লবের প্রভাব মারাত্মকভাবে আলোকিত।

এ পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সাহিত্য আন্দোলনের যে প্রভাব সারা বিশ্বকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। দেশে দেশে শিল্প-সংস্কৃতির নতুন ধারা গড়ে ওঠে। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে ভারতেও সোভিয়েত বিপ্লবের ধাক্কা লাগে। বিশ্বব্যাপী নতুন একটি ব্যবস্থার স্বপ্নালুতায় মানুষ যেন ভাসছে। তার মধ্যে  বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের চেতনা যেন তর পায়। যেটা তার কবি মানসকে করে তুলেছিল আলোক-উদ্ভাসিত। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তৎপর নজরুল তখন ভারতবাসীকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তার সাহিত্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। স্বাদেশিকতার চেতনার আন্দোলনে মুখর নজরুল সংগ্রাম করছে অন্য দিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সুচতুর কৌশলের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ তখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের মাধ্যমে  বিভেদ সৃষ্টিতে তৎপর। সে সময় নজরুল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে লিখেছেন- মানুষের হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নেই। এই বিশ্বাস নিয়ে তিনি সাহিত্য সাধনায় নিমগ্ন হন। সাম্যবাদী চিন্তাকে লালন করে তিনি তার মানসলোকে সম্প্রদায় চেতনার বাইরে যে মানবসত্তার জন্ম দিয়েছিলেন তা হিন্দু ও মুসলিম সম্পর্কের বিভাজক না হয়ে উঠেছিলো সম্প্রীতির অনন্য বাহক। সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষকে উৎপাটন করতে তৎপর কবি লিখেছিলেন-‘কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা/ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা/ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ/ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,/এক মানবের একই রক্ত মেশা/কে শুনিবে আর ভজনালয়ের  হ্রেষা।’                       

(‘বিংশ শতাব্দী’ / ‘প্রলয়-শিখা’)

মানুষকে ও মানবধর্মকে সবচেয়ে বড় করে দেখেছেন  কবি নজরুল ইসলাম। আজীবন তিনি যে চিন্তাকে লালন করেছেন তাহলো- হিন্দু কিংবা মুসলমান নয়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দ্রোহ যেন হয়ে উঠেছিলো তার কবিতার ভাষা। তিনি  স্বপ্ন দেখতেন রুশ বিপ্লব উৎসারিত এক সমাজ বিপ্লব- তথা সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন-  যেখানে শোষণ, বৈষম্যহীন এক অসাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা রয়েছে। সেই সাম্যের সমাজ গঠনের স্বপ্নে বিভোর কবি লিখেছেন-‘গাহি সাম্যের গান-/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’  (‘সাম্যবাদী’)

জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কাজী নজরুল ইসলাম এক অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সকল মানুষের কল্যাণ কামনা করেছেন। নজরুলকে অনেক সময়েই খণ্ডিতভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। কারো কাছে তিনি নাস্তিক, কেউবা তাকে ধর্মবাদী বানানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নজরুল টিকে গেছেন তার লেখার আলোকে। টিকে থাকবেন লেখার আলোকে। তাকে গ্রহণ করতে হবে সমগ্র দৃষ্টিকোণ থেকে। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রথম থেকেই কায়েমি স্বার্থবাদী মহল সহ্য করতে পারেনি। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের স্বার্থান্বেষী চক্র তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছে। আজকের বাস্তবতায় প্রমাণ হয়েছে যে তিনি সর্বকালের আধুনিক। মানবাত্মার মুক্তি সাধনাই নজরুলের সাহিত্যকর্মের কেন্দ্রীয় অন্বিষ্ট। মানুষের সামূহিক অবচেতনায় তিনি  জ্বেলে দিতে চেয়েছেন মানবিকতার আলো। ধর্মীয় কুসংস্কারকে তিনি অতিক্রম করেছেন মানবিকতার শক্তি দিয়ে। তার কাছে ধর্মের জন্য মানুষ নয়, বরং মানুষের জন্যই ধর্ম।

দুই

বাংলা কবিতায় সাম্প্রদায়িকতা ও শোষণ-মুক্তির  বিরুদ্ধে তিনি গেয়েছেন সাম্যের গান তার কবিতা গানসহ সব ধরনের মননশীল রচনায় তিনি সমাজের নিপীড়িত মানুষের জয়গান গেয়েছেন। নজরুল যে মানবিক সমাজ গড়ার ব্রতী ছিলেন, সে সমাজ একটি সাম্যের সমাজ। যে সমাজ হবে অসাম্প্রদায়িক- শোষণমুক্ত ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকারে ঋদ্ধ। ধর্ম, বর্ণ, জাতিবিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে মনুষ্যত্বকে প্রাধান্য দেয়ার এক মানবসমাজ গড়ার পক্ষে ছিলো তার আমৃত্যু লড়াই। যেকারণে তিনি মানবসভ্যতার বিকাশে সবচে সেরা ও সুন্দর চরণটি লিখেছেন তার লেখায়। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’।  এরচেয়ে আধুনিকতম অসাম্প্রদায়িক কথা আর কি হতে পারে? মানুষ মানুষের ভেদ করার কোন পদ্ধতিকে তিনি মানেননি। তার কবিতা বা সাহিত্যেই অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা প্রমাণ করে তিনি চিরকালের আধুনিক। মানুষ ও মানবতার পক্ষে তার অবস্থান, বিপক্ষে জোরালো উচ্চারণ একদম বিরল। শোষণ, বঞ্চনা ও সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে তিনি লিখেছেন- হাত উঁচিয়ে বলেছেন- ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া’।

আজকের পৃথিবীতে মানুষ যখন সম্প্রদায় চেতনার মধ্যে আলাদা হতে মরিয়া। পূঁজির অসম বিকাশের মধ্য দিয়ে কর্পোরেট দুনিয়া মানুষকে এক করে দিচ্ছে। জোট বাধার ক্ষমতাকে খর্ব করছে এমনকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জায়গাটিও নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। তখন নজরুল ইসলামের কবিতার কাছে ফিরে যেতে হয়। কাজী নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা আমাদের উজ্জীবিত করে, আন্দোলিত করে। বিশেষত সামাজিক এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বা অসাম্প্রদায়িকতার মতো বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য নজরুলের কবিতা হয়ে ওঠে হিরন্ময় হাতিয়ার।  

জাত-পাতের ভাগাভাগির বিরুদ্ধে তার অনন্য কবিতা ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ কবিতাটি  খুবই বিপ্লবী ও প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছেন-  ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া/ছুঁ’লেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।।’ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আলোয় ধর্মীয় কুসংস্কার কমলেও সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছেই। সমাজে শ্রেণি- বৈষম্য এখনও রয়েছে। কবির কাছে ‘মানুষ’-ই মুখ্য। সবাই মানুষ। স্রষ্টা একজনই, সবাই তারই সৃষ্টি। তাহলে কেন বিভেদ- বিভাজন থাকবে? নজরুলের শক্তিশালী এই চেতনার বহিঃপ্রকাশ বর্তমান সমাজেও কুঠারাঘাত হানার জন্য জরুরি। ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া। একইসঙ্গে সমাজ বিকাশে নারীর বিরুদ্ধে যে সহিংসতা, নারী প্রগতির প্রতিবন্ধকতা যেভাবে বাড়ছে তাতে নারীর জাগরণে কবি নজরুল ইসলামের দ্রোহের বাণী আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি একদিকে  যেমন নারী ও পুরুষের ঐক্য  চেয়েছেন,  বৈষম্যের অবসান চেয়েছেন। নারীকে প্রগতির  সংগ্রামকে মূলস্রোতে রাখতে চেয়েছেন। সে কারণে তিনি লিখেছেন-‘গাহি সাম্যের গান- /আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো  ভেদাভেদ নাই।/বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর’ [নারী]। 

তিন

নজরুলের ভাবনা বা চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে তার একাধিক কবিতায়। আজ বলতেই হয়, নারী প্রগতির জন্য একাধারে তার সংগ্রামের বহুকাল পরেও আজ নারীদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে হয়। একদিকে সমাজের হাতসম্বল শ্রেণী বা নিপীড়িত মানুষ, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও নারী মুক্তির জন্য নজরুল আজও প্রাসঙ্গিক। আধুনিক চিন্তার কবি হিসেবে তিনি অনন্য। 

সমাজের অশুভ শক্তিগুলোকে নিশ্চিহ্ন করতে যে শক্তির প্রয়োজন- তার অনুপ্রেরণার এক নাম কবি নজরুল। কবিতা বা সাহিত্য যে শক্তির বিশাল আধার হয় তা তিনি প্রমাণ করে গেছেন। নজরুল কবিতাকে সমাজকাঠামো বদলের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছেন। নতুন সমাজ কাঠামোর নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন। তার স্বপ্নে সফল বাস্তবায়ন না হলেও তার চিন্তার জায়গায় আজও তিনি প্রাসঙ্গিক ও আধুনিক।

উল্লেখ্য, কাজী নজরুল ইসলাম আজকের এই দিনে পরপারে যাত্রা করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তিনি আমাদের জাতীয় কবি। তার অসামান্য সৃষ্টি, সংগ্রামী জীবন ও কর্মের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫