নূরজাহান: নির্যাতিত নারীর প্রতিচ্ছবি ও ভণ্ড ফতোয়াবাজদের মুখোশ উন্মোচন

কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক ও নাট্যকার ইমদাদুল হক মিলন চারদশকের বেশি সময় ধরে লিখেছেন অসংখ্য উপন্যাস, গল্প ও নাটক। বাংলাদেশে শুধুমাত্র লেখালেখিকেই পেশা হিসাবে বেছে নেয়ার সাহস তিনি দেখিয়েছেন। লেখালেখির পাশাপাশি বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পুরনো ঢাকার জীবন থেকে কিছু না ভেবেই লেখালেখি শুরু করেছিলেন তিনি। ১৯৭৭ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় 'সজনী' নামে একটি ছোট গল্প লিখে পাঠকের দৃষ্টি আর্কষণ করতে শুরু করেন।

‘নূরজাহান’ উপন্যাস দিয়ে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যাওয়া এই লেখকের লেখকখ্যাতি বর্তমানে দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশের পাঠকের হৃদয়েও স্থান করে নিয়েছে। সাহিত্যবোদ্ধাদের কেউ কেউ তার উপন্যাস ‘নূরজাহান’সহ অন্যান্য রচনাকে ধ্রুপদি সাহিত্যের মর্যাদায় ভূষিত করেছেন নিঃসংকোচে। 

ইমদাদুল হক মিলনের  সুদীর্ঘ উপন্যাস ‘নূরজাহান’  লিখেছেন গ্রামবাংলার বাস্তব চিত্র থেকে। এক পাকা সড়কের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে প্রতিদিন সেই গ্রাম। শহরের হাওয়া লেগে গেছে যেন গ্রামে। মানুষের মধ্যে উত্তেজনা। কার্তিকের বৃষ্টিতে ডাগর হচ্ছে বাকসা ঘাস, চালতা পাতার ফাক দিয়ে ঝরে পড়ছে অদ্ভুত উষ্ণ রোদ। এরই মধ্যে বেড়ে উঠছে পল্লিবালিকা নূরজাহান। সরল হাসি লেগে থাকে তার মুখে। শীতের খেজুর গাছের অপেক্ষায় বসে থাকে দবির গাছি। আর ভাবে মেয়েটি বিয়ের পর কোন সংসারে গিয়ে খাঁচার পাখিটি হয়ে যাবে। নুরজাহানের বড় হয়ে ওঠা, বিয়ে, দুর্ভাগ্য, ভণ্ড ফতেয়াবাজের হাতে অপমানিত হওয়া এবং আত্মহত্যার করুণ কাহিনির পাশে লেখক এক গ্রামীণ জনপদের মানুষের জীবনচিত্র এঁকেছেন নিপুণ হাতে। এ উপন্যাস মৌলভীবাজার জেলার ছাতকছড়া গ্রামের একটি সত্য ঘটনা নিয়ে লেখা। বিয়ের পর নূরজাহানের স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। গাঁয়ের মসজিদের ইমাম তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু নূরজাহানের বাবা আধবয়সী মাওলানার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয়নি। গাঁয়েরই মােতালেব নামে এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হয়। এতে ইমাম ফতােয়া জারি করেন যে নূরজাহানের দ্বিতীয় বিয়ে বৈধ হয়নি। তাই ফতােয়ার বলে নূরজাহান ও তার স্বামীকে কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর মারা হয় এবং তার বাবাকে করা হয় বেত্রাঘাত। মেয়েটিকে বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর ছোড়া হলো। পাথর তার মুখমণ্ডল ক্ষতবিক্ষত করে দিল, কিন্তু তার থেকে বেশি ক্ষতবিক্ষত করল তার আত্মসম্মানবোধকে, মানুষ হিসেবে তার পরিচিতিকে এবং সমাজ, মানুষ ও ধর্মের ওপর তার বিশ্বাসকে। এক বিশাল অবিশ্বাস এবং অপমানের ভার সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি আত্মহত্যা করল। ইমদাদুল হক মিলনের মনেও ঘটনাটি গভীর দাগ কাটল। মেয়েটির জন্য তাঁর গভীর মমতা হলো। যে ইমামের ফতোয়া মেয়েটিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল, তার প্রতি তাঁর ঘৃণা জাগল। কিন্তু মেয়েটিকে তাঁর সহানুভূতি, তাঁর ভালোবাসা যে জানাবেন, তার কোনো উপায় নেই। মসজিদের ওই ইমামকে তিনি হয়তো তাঁর ঘৃণার কথা জানাতে পারতেন, কিন্তু তাতে তেমন কোন লাভ হতো না। মিলন সিদ্ধান্ত নিলেন, পাঠকের মনে চিরকালের জন্য একটা জায়গা তাকে করে দেবেন। আর নিষ্ঠুর ইমামকে তিনি পাঠকের আদালতে হাজির করবেন দিনের পর দিন, তারা তাকে শাস্তি দেবে। আরো গুরুত্বপূর্ণ যা, আমাদের চারদিকে প্রচুর বিপন্নতা নিয়ে বেঁচে থাকা বাস্তব জীবনের এ রকম মেয়েগুলোকে পাঠকরা সুরক্ষা দেবে। একটি উপন্যাসের অনেক শক্তি। পাঠককে জাগাতে পারে তুমুলভাবে। ঘটনাটি অন্য আরো অনেকের মতো ইমদাদুল হক মিলনকে ব্যথিত করল। মনের মধ্যে দুঃখ ও ক্ষোভ জমা হল।  

মিলন তাঁর লেখার শক্তিতে বিশ্বাসী, সে জন্য তাঁর লেখা পাঠককে স্পর্শ করে। ইমদাদুল হক মিলন লিখলেন উপন্যাস 'নূরজাহান'। নূরজাহান উপন্যাস সম্পর্কে লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন— "উপন্যাসটির প্রায় ১১০০ পৃষ্ঠার কলেবর এই বিস্তার তৈরি করেনি, করেছে মিলনের কল্পনার বিশালতা— এক সামান্য গ্রামের অসামান্য এক জীবনচিত্রকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সচল রাখার তাঁর ক্ষমতা; এক বিশাল ক্যানভাসে অসংখ্য চরিত্রকে তাদের নিতান্ত ব্যক্তিগত আর সামষ্টিক জীবন নিয়ে হাজির করা, ছোট ছোট ঘটনা দিয়ে ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তের দিকে গল্পরেখাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আর মানুষের সঙ্গে প্রকৃতি আর ঋতুবদলের ভেতরের রসায়নগুলোকে সম্পৃক্ত করার তাঁর দক্ষতা। মিলন সংবেদী লেখক, তিনি একটা কোমল হাত রাখেন তাঁর অকিঞ্চিৎকর সব চরিত্রের পিঠে, তাদের আনন্দে হাসেন, তাদের দুঃখে কাঁদেন। কিন্তু তাঁর বর্ণনায় এর প্রকাশ্য ছায়াপাত ঘটাতে দেন না। তিনি অনেক ঘটনায় নিজেকেও বিনিয়োগ করেন, তাঁর পক্ষপাতিত্ব আমরা টের পাই, তাঁর ক্রোধ অথবা পুলক আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু সেগুলো গল্পের একটা গভীরেই শুধু সক্রিয় হয়। গল্প বলায় তিনি একটা বস্তুনিষ্ঠতা মেনে চলেন। ফলে পাঠক একটি ঘটনার অনিবার্যতাকে যেমন বাস্তবের কার্যকারণ সূত্রে ফেলে মাপতে পারেন, তেমনি এর পেছনে লেখকের পক্ষগ্রহণের বিষয়টিও অনুধাবন করেন। 

নূরজাহানকে ফতোয়া দিয়ে দুজন শাগরেদ লাগিয়ে তাকে একটা গর্তে পুরে মসজিদ বানানোর খোয়া—সুরকি ছুড়ে মাওলানা মান্নান তার প্রতিহিংসা মেটাল। নূরজাহানের মুখ ও মাথা রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হলো, সে একসময় টলতে টলতে উঠে বাড়ি গিয়ে অ্যানড্রিন খেল, এবং তার মারা যাওয়ার পর মেদিনীমণ্ডলের দৃশ্যপট বদলে গেল। পুলিশ এলো এবং মাওলানা মান্নানকে ধরে নিয়ে গেল কোমরে দড়ি দিয়ে, যে রকম দড়ি দিয়ে নিষ্পাপ মাকুন্দা কাশেমকে সে চোর সাজিয়ে গ্রাম থেকে বিদায়  করে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু পুলিশের এক কর্তা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, এবার রাজাকার মাওলানাকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পিছু পিছু তাড়া করে আসা বাদলা নাদের হামেদ আলালদ্দি বারেকের মতো কিশোর তরুণরা পাষণ্ড মাওলানাকে যখন ঢিল ছুড়ে মারছে, সে কিছুই বলল না। মাওলানার মুখে-মাথায় ঢিল পড়তে দিল। 

এ উপন্যাসে লেখক  লেখেন, “আর কথা নাই। হালটের পাশ থেকে তুমুল ক্রোধে বৃষ্টির মতন চাকা পড়তে লাগলো মান্নান মাওলানার মুখে। হাত তুইলা, মুখ নিচা কইরা, চিৎকার চেঁচামেচি কইরা নানানভাবে পোলাপানের চাকার হাত থেকে নিজেরে রক্ষা করতে চাইলো, পারলো না।” এই বর্ণনা কি কোনো চরিত্র দিচ্ছে? না, দিচ্ছেন লেখক। কিশোর-তরুণদের হাতে মান্নান মাওলানার শাস্তি পাবার দৃশ্যে কেন তিনি চলে গেলেন তাঁর শৈশব-কৈশোরের মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের ভাষায়, ক্ষণিক ছুটি নিলেন সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারীর অবস্থান থেকে, হয়ে গেলেন বাদলা নাদের হামেদদের একজন? ‘নূরজাহান’-এ মিলন নিজে আছেন, এবং তাঁর যে সত্তার আড়ালে বর্ণনাকারী তার গল্প বুনে যায়, নিঃশব্দে জাল বুনে যাওয়া কোনো মাকড়সার মতো, সে নিজেই তো রক্তাক্ত। রূঢ় বাস্তব, বাস্তবের কল্পনা আর কল্পনার বাস্তব এমন অনিবার্যভাবে মিলে যায় এই উপন্যাসে যে, কোনো ঘটনাকেই আর কল্পিত মনে হয় না। ইমদাদুল হক মিলন উত্তরাধুনিক লেখক না হলেও  তিনি গল্প বলার ঐতিহ্যকে ধারণ করেন। সেই ঐতিহ্যে পক্ষগ্রহণ একটা স্বাভাবিক ঘটনা। তবে বিষয়টা আরো গভীর—এবং তা হচ্ছে, পক্ষগ্রহণে গল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় কি না! ইমদাদুল হক মিলন দেখান, ক্ষতি নয়, তাতে লাভ হয়। একটা বিশাল ক্যানভাসের কাজ একটা জায়গা খুঁজে পায়। নূরজাহানের পুনর্জন্ম হয়, পাঠকের চেতনায়। পৃথিবীর সব মান্নান মাওলানা একজোট হয়েও তাকে আর মারতে পারে না। ‘নূরজাহান’-এর শেষ অংশে ইমদাদুল হক  মিলন  ঋতু ধরে ধরে অগ্রসর হয়ে মেদিনীমণ্ডল গ্রামটির একটি চালচিত্র মেলে ধরেছেন, তাতে মান্নান মাওলানার চরিত্রটি অপ্রতিরোধ্য মনে হয়েছে। মাকুন্দা কাশেমকে পিটিয়ে মৃতপ্রায় করে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার পর তার অবস্থান আরো পোক্ত হয়েছে। এই উপন্যাসের খল চরিত্রগুলো প্রায় সবাই একটা অপ্রতিরোধ্য অবস্থানে চলে যায়। আতাহার, সড়কের কন্ট্রাক্টর আলী আমজাদ এবং আতাহারের সাঙ্গপাঙ্গকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে তেমন মনে হয় না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় তাদের পরাজিত হওয়া তো দূরের কথা, তাদের কেউ বিপদে ফেলতে পারে, সে রকম ভাবারও কথা নয়। কিন্তু সবাই তারা হেরে যায়। মান্নান মাওলানার মুখে যেদিন নূরজাহান থুতু ছিটিয়ে দিল, সেদিন থেকেই তার সেই পরাজয়। ধূর্ত ও নিষ্ঠুর এই মাওলানা এরপর প্রতিশোধ নিতে নামল। তার পরিকল্পনা ধরে সে এগোল। দেলোয়ারার ভালোমানুষি এবং এনামুলের বদান্যতায় সে একটি মসজিদের ইমাম হলো। এর আগে সে নূরজাহানকে স্ত্রী হিসেবে অধিকারের চেষ্টা করে বিফল হলেও প্রতিশোধটা সে ঠিকই নিল। তার বিরুদ্ধে একটা ফতোয়া দিয়ে নিজেই বসল বিচারে। 

বাংলাদেশের নূরজাহানদের কপালে এই তো লেখা থাকে, আর বাংলাদেশের মান্নান মাওলানাদের এমনই অবস্থা হয়। এই পরাজয়কে একটা প্রতীকী মাত্রায় বাংলাদেশের জেগে ওঠা হিসেবেও দেখিয়েছেন। মাকুন্দা কাশেমের মৃত্যুর সময় জেগে ওঠা মানুষ স্তব্ধ হয়ে ছিল, মান্নান মাওলানার শাস্তি নিশ্চিত করার সময় জেগে থাকা মানুষ স্তব্ধতা ভেঙে সক্রিয় হয়েছে। সক্রিয় হয়েছে কিছু কিশোর—নতুন প্রজন্ম যারা, এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানও, তবে সবচেয়ে বড় কথা, সক্রিয় হয়েছে মানুষের বিবেক, এমনকি প্রকৃতিও। ছাতকছড়ার  নূরজাহান মরেছিল ফতোয়ার আঘাতে। মেদিনীমণ্ডলের নূরজাহানও। লেখক  ফতোয়াকে  ইসলামের দৃষ্টি দিয়ে পড়েছেন। অসংখ্য বই পড়েছেন। রীতিমতো গবেষণা করেছেন—যেন তিনি উপন্যাস নয়, একটি অভিসন্দর্ভ লিখেছেন। কত অভিনিবেশ নিয়ে তিনি ইসলামের নীতি ও বাণীগুলো খুঁটিয়ে পড়েছেন, মহানবী (সা.)-এর জীবনী ও হাদিস পড়েছেন, ধর্মের ব্যাখ্যা এবং ইসলামে নারীর অধিকার বিষয়ে অনুসন্ধান করেছেন। ধর্মের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল, কারণ তিনি সেই লোকজ ঐতিহ্যে বেড়ে উঠেছেন, যা ধর্মের সত্যিকার সারটুকু গ্রহণ করে, এবং করে সমৃদ্ধ হয়। তাঁর এই উপন্যাসে মান্নান মাওলানার এক বিপরীত চরিত্র আছেন, মাওলানা মহিউদ্দিন, যিনি ইসলামের মূল্যবোধগুলো ধারণ করে  আলোর পথ দেখান  প্রতিটি মানুষকে। মান্নান মাওলানা গ্রামের ছনু বুড়ি মারা গেলে তার জানাজা পড়াতে অস্বীকার করল, যেহেতু ছনু বুড়ি টুকটাক চুরি করে। মাওলানা মহিউদ্দিন তার জানাজা পড়ালেন, তার ছেলেকে সান্ত্বনা দিলেন। তাঁকে দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়।

মাওলানা মহিউদ্দিন  ভালো মানুষ, তাঁর কিছু দায়িত্ব আছে, তিনি মসজিদের ইমাম। সেই দায়িত্ব তিনি সুচারুভাবে পালন করেন। দবিরও তার দায়িত্ব পালন করে, মরণিও। এ উপন্যাসে ফতোয়াবাজদের চরিত্র উন্মোচনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি ও গ্রামীণ মানুষের জীবনচিত্র রূপলাভ করেছে। নূরজাহান হয়ে উঠেছে এক প্রতিবাদী চরিত্র। গ্রাম বাংলার নির্যাতিত নারীদের প্রতিচ্ছবি নূরজাহান। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh