হান কাং: একজন দায়বদ্ধ লেখকের প্রতিকৃতি

এ বছর সাহিত্যে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান ও কাঙ্ক্ষিত নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাং। তাকে কেন এ পুরস্কার প্রদান করা হলো তার ব্যাখ্যায় নোবেল কমিটি বলেছে, হান কাংয়ের গদ্য তীক্ষ্ণ ও কাব্যময়। তার লেখায় ইতিহাসের যন্ত্রণাবিদ্ধ বিষয়ের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে বোঝাপড়ার প্রচেষ্টা রয়েছে; রয়েছে মানবজীবনের প্রতি পরিচ্ছেদে ভঙ্গুরতার কথাও। 

দক্ষিণ কোরিয়ায় তিনিই প্রথম লেখক, যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন। গত বৃহস্পতিবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা করা হয়েছে নোবেল কমিটির তরফ থেকে। সেই ঘোষণায় উঠে এসেছে ৫৩ বছর বয়সী হান কাংয়ের নাম। হান কাংয়ের লেখক জীবন বর্ণাঢ্য। লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল দক্ষিণ কোরিয়ার একটি সাময়িকীতে একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। তবে ১৯৯৫ সালে তার ছোটগল্পের একটি সংকলন প্রকাশ হওয়ার পর তিনি পাঠকের সামনে আসেন। তার সাহিত্য কর্মের গোড়াপত্তন ঘটেছিল এই গল্প সংকলন প্রকাশের মধ্য দিয়ে। একটি ছোট গল্প সংকলনের মধ্য দিয়ে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সাহিত্যাঙ্গনে যে দাগ-রেখা অংকন করেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় লেখক-সমাজে তার অবস্থান দৃঢ় হয়েছিল। 

বলা যায় কবিতা দিয়ে সাহিত্যের সূচনা করলেও গল্প সংকলনের মধ্য দিয়ে তিনি পাঠকের সামনে আসেন। তার গল্পে সমাজের যে চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে এবং তার গল্পের সঙ্গে লেখক ও পাঠকের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তারই ধারাবাহিকতায় হান কাং দীর্ঘাকার গদ্য লিখতে শুরু করেন।

‘দ্য ভেজেটারিয়ান’ তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বইয়ের একটি। ২০০৭ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসের জন্য ২০১৬ সালে ‘ম্যান অব বুকার পুরস্কার’-এ ভূষিত হয়েছিলেন। এ উপন্যাসে মানুষের নিষ্ঠুরতার নির্মম পরিণতির শিকার আতঙ্কিত এক তরুণীর ‘জড় বৃক্ষের মতো’ বেঁচে থাকার যে চিত্র হান কাং এঁকেছিলেন তা পাঠক-সমাজের মননে অনুরণন তুলেছিল। ‘গভীর কাব্যিক গদ্য, যা ঐতিহাসিক আঘাতগুলোকে উন্মোচন করে এবং মানবজীবনের নাজুকতাকে সামনে আনে’ এই অনন্য লেখনীশৈলীর জন্য তাকে এ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।

এর আগে, ২০২৩ সালে নরওয়ের লেখক ও নাট্যকার জন ফস সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি তার ‘উদ্ভাবনী নাটক ও গদ্য’-এর জন্য নোবেল পুরস্কার পান, যা অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলোর কণ্ঠ দেয়।

নোবেল কমিটি তার পুরস্কার ও সাহিত্যের যে দিকটিকে বিবেচনায় নিয়েছিল সেটি ছিল- তার গদ্যের কাব্যময় দিক ও বহুমাত্রিকতা, যার মধ্য দিয়ে দেখা যায় হান কাংয়ের অনুসন্ধিৎসু মন-মানুষের জীবনের নানা দিককে সাহিত্যশৈলীর মাধ্যমে এমনভাবে এগিয়েছে যে, তার সাহিত্যকর্মকে কোনো সীমানায় আটকানো যায় না। বাস্তব জীবনযাপনের ধারাপাতে তিনি সূক্ষ্ণ গদ্যশৈলীর মধ্য দিয়ে তুলে এনছেন সামাজিক সহিংসতা, মানুষের দুঃখকষ্ট ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নানা বিষয়-আশয়। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য ভেজেটারিয়ান’ বুকার জয়ের পর ২০১৬ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ডেবোরাহ স্মিথ, যদিও প্রায় এক দশক আগে প্রকাশ হয়েছিল হান কাংয়ের এ খ্যাতনামা উপন্যাস। 

উপন্যাসটি ম্যান বুকার পুরস্কার লাভ করার মধ্য দিয়ে লেখক হিসেবে হান কাংয়ের জীবন পাল্টে যায়। এরপরই এক এক করে প্রকাশ হয় তার অন্য আরও কয়েকটি উপন্যাস ‘দ্য হোয়াইট বুক’, ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’ ও ‘গ্রিক লেসনস’ ইত্যাদি। 

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার অনুষ্ঠানে সুইডিশ অ্যাকাডেমির স্থায়ী সচিব ম্যাটস মাম বলেছেন, শরীরের সঙ্গে আত্মার, জীবিতের সঙ্গে মৃতের যোগাযোগ নিয়ে হান কাংয়ের সচেতনতা অসাধারণ। তার গদ্য কাব্যিক ও নিরীক্ষাময়। সমসাময়িক গদ্যসাহিত্যে তিনি একজন উদ্ভাবকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন। নোবেল পুরস্কার কমিটি ১৯০১ সাল থেকে সাহিত্যে পুরস্কার দিয়ে আসছে। হান কাংকে নিয়ে ১৮তম বারের মতো একজন নারী পুরস্কারটি পেলেন।

১৯৭০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে জন্মেছিলেন হান কাং। এর পর সিউলে বসবাস শুরু করেন। ছোটবেলা থেকেই শিল্প, সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন তিনি। কাব্যচর্চায় ঝোঁক ছিল বরাবর। তার বাবাও একজন নামকরা ঔপন্যাসিক। গদ্য লেখার পাশাপাশি ছবি আঁকা এবং সংগীতচর্চাতেও সমান আগ্রহ রয়েছে তার। নোবেল পুরস্কার বোর্ড তার পরিচিতি দিতে গিয়ে বলেছে, তিনি এমন একজন, যিনি সংগীত ও শিল্পকলার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। 

কোরিয়া টাইমসের কাছ থেকে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়ায় হান কাং বলেছেন, নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেও তার আনন্দে তিনি পুরস্কার উদযাপন বা সংবাদ সম্মেলন করবেন না। তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতসহ বিশ্বের করুণ সব পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘বিশ্বে যখন যুদ্ধ বৃদ্ধি পায় এবং প্রচুর মানুষ নিহত হয়, তখন নোবেল পুরস্কার উদযাপন করার সময় নয়।’

 হান কাং কোরিয়া টাইমসকে বলেন, ‘আমরা যখন বিশ্বের এই দুঃখজনক ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করছি, ঠিক সেই মুহূর্তে দয়া করে এই পুরস্কার বিষয়টি উদযাপন করবেন না। সুইডিশ একাডেমি আমাকে মজা করার জন্য এই পুরস্কার দেয়নি। এই ভূমিকার মধ্য দিয়ে তাকে বিশ্বের একজন দায়বদ্ধ লেখকের তালিকায় ফেলা যায়। যেসব যুদ্ধ নিয়ে সারা বিশ্ব চুপ তখন নোবেল বিজয়ী হান কাংয়ের এ বক্তব্য সারা বিশ্বের যুদ্ধাহত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে চলে যায়। 

একজন লেখক শুধু ভালো লেখক হলেই চলে না। বিশ্বের মানুষের প্রতি তার এই সমবেদনা ও দায়বদ্ধতা সারাবিশ্বের লেখকদেরও প্রণীত করবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh