গত এপ্রিলে শিল্পী রশিদ চৌধুরীর ৯২তম জন্মদিনটি চলে গেল অন্যান্য অনেক দিনের মতোই। তিনি নিজেও চলে গিয়েছিলেন মাত্র ৫৪ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালে। সামনের ১২ ডিসেম্বর তার অকাল প্রয়াণের ৩৮ বছর। তার স্মৃতিধন্য চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকা, কোনো চারুকলা প্রতিষ্ঠানেই কি কোনো স্মরণ কার্যক্রম থাকে বা আছে শিল্পী রশিদকে ঘিরে? জানি না, না থাকলেও রশিদের কি এমন যায়-আসে!
শিল্পী রশিদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমাজ, সময় ও জ্ঞানের প্রতিচ্ছবি উপলব্ধিতে সচেতনতা বজায় রেখে, দুইয়ের সম্পর্কের সূক্ষ্ম পার্থক্যকে বুঝতে চেষ্টা করা যায়। সাধারণত কোনো খ্যাতিমান ব্যক্তি প্রয়াত হলে তাকে ঘিরে অতিরঞ্জিত স্মৃতিচারণা এবং নিজেদের সম্পর্কের গভীরতা প্রমাণের নানা প্রচেষ্টা দেখা যায়। এই প্রচেষ্টায় অনেক বানানো গল্প বা গোপন অভিপ্রায় কাজ করে, যা নির্দোষ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে আত্মঘাতী প্রবণতার অংশ। রশিদকে ঘিরে এমন অনেক প্রচেষ্টা যেমন ছিল, তেমনই তাকে উপেক্ষা করার বা ভুলিয়ে দেওয়ার ইচ্ছাও কার্যকর ছিল। এ ধরনের বিস্মরণপ্রবণতা শুধু অমার্জিত উদাসীনতা নয়, বরং একটি পরিকল্পিত কর্মসূচি।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে ঢাকা চারুকলার শিক্ষার্থী হিসেবে, শিল্পমাধ্যমের সন্ধানে আমি ব্যস্ত ছিলাম। চারপাশের সৃষ্টিশীলতাকে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, যা আমার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত এবং গভীর করত। সেই সময় শহরের জীবনের স্পন্দন এবং তার অস্থিরতা গভীরভাবে উপলব্ধি করছিলাম, যা আবেগে আমাকে আন্দোলিত করত। এই প্রেক্ষাপটে রশিদের ট্যাপেস্ট্রি আমার আবেগে শৃঙ্খলা এনে দিয়েছিল এবং এক ধরনের ভারসাম্য প্রদান করেছিল। শিল্পী রশিদ চৌধুরী তার শিল্পে স্বকীয় চিন্তা ও অনুভূতির মাধ্যমে অভিজ্ঞতা, প্রেরণা এবং নানা অভিঘাতে তিনি ক্রমাগত নিজের শিল্পকর্মে অনন্যতা তৈরি করেছেন। গভীর মনোযোগ, আঙ্গিকের নিখুঁত প্রয়োগ, দক্ষতা ও চেতনার সমন্বয়ে তিনি তার নিজস্ব শিল্পরূপ নির্মাণ করেছেন। এভাবে রশিদের শিল্পকর্ম প্রথাগত কাঠামো ভেঙে এক স্বতন্ত্র শিল্পধারার পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠেন।
‘বাংলায় বিদ্রোহ’ সময় চিহ্নিত শিল্প
১৯৭১ সাল। স্বাধীন বাংলাদেশ যুদ্ধজঠর থেকে কিছুদিন বাদে ভূমিষ্ঠ হবে। আর তার আগেই রশিদের শিল্পজঠর থেকে ভূমিষ্ঠ হলো ‘বাংলায় বিদ্রোহ’ নামের অসাধারণ ‘সময় চিহ্নিত কাল’-এর সাক্ষী, রেখানির্ভর অনাড়ম্বর এক সাহসী সংবেদী শিল্পকর্মের।
দেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতার আগেই নানা পেশাজীবী মানুষ একাত্ম হয়েছিলেন। চিত্র শিল্পীদের মধ্যে রশিদ চৌধুরীও একাত্ম হয়েছিলেন শুধু নয়, একাত্মতা গড়ে তুলতে প্রেরণাদায়ী চিত্র এঁকেছেন। তিনি তখন চট্টগ্রামে। তার এক যুগের চট্টগ্রাম বসবাসের সময়টি ছিল
দেশমাতৃকার অত্যন্ত ক্রান্তিকাল। তখনকার চারুকলা শিক্ষার প্রসারের দায়িত্ব, মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বদেশ ও স্বাধিকারের প্রতি দায়বদ্ধ শিল্প অন্তঃপ্রাণ রশিদ চৌধুরী। স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের সময়ে তার আঁকা ‘বাংলায় বিদ্রোহ’ শিল্পকর্মেরও ৫৩ বছরে শিল্পী রশিদ চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
বাংলার সনাতন সংস্কৃতি তার প্রতিবেশ যেমন- উদ্ভিদ পশুপাখি সবই পরস্পর নির্ভরশীল সঙ্গী। প্রাকৃতিক জীবনাচার ঘনিষ্ঠ এই একাত্মতা। সংগ্রামে সংক্ষোভেও তারা প্রত্যেকেই সহযোগী। এমনতরো ভাবতে পারা রশিদ তাদের এক কাতারে প্রতিরোধে শামিল করতে পারেন। অবয়বী চিন্তাকে তার ‘খোলনলচে’ সমেত ভাবগতিককে ধরেছেন। যেখানে নির্মিত অবয়বহীনতা কোনোভাবেই বস্তু সবার ভাবভঙ্গি বিচ্যুত করে না। ফলে দৃশ্যের পরতে পরতে বিনির্মাণের তোড়জোড় চলে দৃশ্যায়নে পরিব্যাপ্ত চরিত্রাবলির সমিল স্থির লক্ষ্যে আগুয়ান ভঙ্গিতে।
১৯৭১ সালে ‘শিল্পী সাহিত্যিক সংস্কৃতিসেবী প্রতিরোধ মঞ্চ, চট্টগ্রাম’ এই নামে সাংগঠনিক উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘বাংলায় বিদ্রোহ’ শিরোনামের চিত্র প্রদর্শনীর প্রকাশনায় তাদের বক্তব্য ছিল “বাংলায় আজ বিদ্রোহ। হাজার বছরের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় : বাংলা যুগে যুগে বিদ্রোহ করেছে- অন্যায়, অবিচার আর অনুশাসনের বিরুদ্ধে। জনগণের কল্যাণ কামনায়, গণমানুষের মুক্তির জন্যে বাঙালির সংগ্রাম বিরামহীন। আজকের বিদ্রোহ আমাদের আগামী দিনের বিপ্লবেরই পূর্বাভাস। বাংলা দেশের প্রতিটি মানুষ আজ সার্বিক মুক্তি সংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ। অংশগ্রহণে সংকল্পবদ্ধ শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমাজ। চট্টগ্রামের ছয়জন বিশিষ্ট শিল্পী সক্রিয়ভাবে এই আন্দোলনের অভিযাত্রী। রশিদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, সাবিহ-উল-আলম, মিজানুর রহিম, সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ এবং আনসার আলী অঙ্কিত ‘বাংলায় বিদ্রোহ’ ছয়টি চিত্র সংগ্রামী জনমানসে নতুন অভিব্যক্তি সঞ্চার করবে বলে আশা করি।”
মশাল ও পতাকা হাতে দুর্নিবার ভঙ্গিতে অগ্রসরমান প্রতিরোধ প্রত্যয় চিত্রটির প্রাণ। যেখানে সাদাকালো এই ছাপ ছবিটিতে একটি পরিবার সন্তান-সন্ততি, গবাদি পশু, বাঘ, সাপ, কুমিরও সহযাত্রী হয়েছে। আসন্ন যুদ্ধের চিন্তা তাতে অংশগ্রহণের সামগ্রিকতাকে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলার সর্বব্যাপী বহিঃশত্রুর আগ্রাসনে, আক্রমণে মানুষ, পশু, পাখি, জলজ ও ডাঙ্গার সব প্রাণবৈচিত্র্যই যে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শত্রুকে পরাজিত করতে হবে, এটাই এই চিত্রের সর্বজনীন বাণী। যুদ্ধের সর্বজনীনতাকে এখানে মানুষের যাপনবেষ্টিত প্রাণবৈচিত্র্যের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সমেত প্রতীকী সারাৎসারসহ প্রতিষ্ঠা দেয়।
শিল্পী দর্শকের জন্যও অনেকটা কাজ ফেলে রাখেন। উত্তীর্ণ মহৎ শিল্পে এই অব্যক্ত অনির্বচনীয় ভারটুকুই মুখ্যত শিল্পের মূল রসদ। সেখানে শিল্পের রস আছে। অমোঘ রসালঙ্কার জন্ম হয় শিল্পভোক্তার মনে, শিল্পীর দায় কেবল ভোক্তাকে তার সন্ধান বাতলে দেওয়া। শিল্পী আয়না বাড়িয়ে দেয়, যে আয়নায় কলা দর্শক নিজেকে দেখার সঙ্গে মুগ্ধতা পাশ কাটিয়ে দেখেন ছাইচাপা আগুনও, সেই উসকে দেওয়ার উসকানিটুকুই দ্রোহী শিল্পের কাজ।
একটি দেশের জাতির রাষ্ট্রিক উদ্বোধনে যে সাংঘর্ষিক বিদ্রোহাত্মক সংগ্রামী যুদ্ধের জাগরণ তার মর্মমূলীয় ভাষা আত্মস্থ করে ইতিহাসের সেই বিশেষ ক্ষণের মানবমুক্তির তথা অত্যাচার নিগ্রহের নিগড় থেকে পরিত্রাণের পরিসমাপ্তির তথা বিজয় অর্জন এই বৃহত্তর চিন্তার সঙ্গে নিজের সৃজনকর্মকে ওতপ্রোত করে নিতে পারাই স্মরণযোগ্য দ্রোহের আত্মপ্রেরণাচালিত শিল্পীর শিল্পিত উৎসর্জন এর প্রতিভাস বলে চিহ্নিত হতে পারে।
তথাকথিত সমসাময়িক আধুনিকতার যেসব চর্চিত প্রবণতা তার বাইরে থেকেই রশিদ চৌধুরীর সমাজ ও দেশ চেতনার স্বরূপকে বুঝতে উদ্যোগী হতে হয়। তার দ্রোহ ও প্রতিবাদের রকমও ভিন্ন, বাকি সব চেনা প্রক্রিয়ার ভাষা থেকে পৃথক। ফলে শিল্পী রশিদের শিল্প ভাষা নির্মাণে তার রূপকাশ্রয়ী আদলে সমাজনিষ্ঠ বয়ান তৈরি হয়। সমাজ তার দেশমাতৃকার প্রাণ-প্রকৃতিকে অক্লেশে প্রতীকায়িত করে দ্রোহের সনদে জায়গা করে দেন। তা সরাসরি আঘাত-প্রতিঘাত না হয়ে বিবেকের ‘ধ্বংস ও স্থিতি’ ধারণার সঙ্গে সংগতি রেখে নির্মিত হয়। তার এই শিল্পকর্মে স্বদেশ ও স্বাধিকারের রং রেখা হয়ে ওঠে উদ্বুদ্ধ-উৎকর্ষ-উৎসর্জনের উসকানি।
স্বোপার্জিত শিল্পমুদ্রার স্বাক্ষর এঁকে গেছেন তিনি নানা রঙে-রেখায়-বুননে তার জীবদ্দশাতেই। আমার মতো নিতান্ত অপ্রতুল বীক্ষায় তার অতুল এক শিল্প ঐশ্বর্যের পাঠ তার স্মরণের নিয়ামক হোক। সেলাম শিল্পী রশিদ চৌধুরী।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh