
শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত
বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান রূপকার ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্র-উত্তর সাহিত্যে এখন যেমন প্রথমেই উচ্চারিত হয় জীবনানন্দ দাশের নাম তেমনি জীবনানন্দ দাশের পরবর্তী সময়ের প্রধান কবি তথা শেষ উত্তরসূরি হিসেবে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে চিহ্নিত করেছেন অনেকে ।
কৃত্তিবাস তখন দিনে দিনে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। প্রায় সারাক্ষণই আত্মমগ্ন এই কবি মানুষটির সঙ্গে আমার আলাপ সেই ১৯৭৭ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে। আমি তখন আমাদের পারিবারিক বইয়ের ব্যবসাসংক্রান্ত কাজে কলকাতায় গিয়েছি। ব্যবসার কাজে তখন মাঝেমধ্যেই কলকাতা যাওয়া হতো। একসময় কেমন করে যেন প্রায় নিয়মিত আসা-যাওয়ার স্থান হয়ে উঠেছিল আনন্দবাজার পত্রিকা অফিস । সেখানে কয়েকবার যাওয়া-আসার জন্য অনেকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়ে গিয়েছিল এবং তখন আনন্দবাজারে পেয়েছিলাম রমাপদ চৌধুরী, সন্তোষ কুমার ঘোষ, সাগরময় ঘোষ, পূর্ণেন্দু পত্রী, বরুণ সেনগুপ্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ আরো অনেককে এবং বেশি সময় কাটাত শক্তিদা, বরুণদা আর পূর্ণেন্দুদা’র সঙ্গে।
যতদূর মনে পড়ে শক্তিদা তখন ছোটদের পাতা দেখতেন, পূর্ণেন্দুদা ছিলেন আর্টিস্ট আর বরুণদা ছিলেন আনন্দবাজারের কূটনৈতিক সংবাদদাতা এবং পরে একসময় তিনি ‘দৈনিক বর্তমান’ পত্রিকার সম্পাদক হয়ে চলে গিয়েছিলেন । আমি সাধারণত দুপুরের পরে যেতাম আনন্দবাজারে ও বেরুতাম একেবারে শেষ বিকেলে ও প্রায় দিনই শক্তিদার ইচ্ছানুসারে, তার সঙ্গেও আমি থাকতাম। তখন মহাত্মা গান্ধী রোডে পূরবী সিনেমার উল্টোদিকে তিনি থাকতেন। এ জায়গাটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় শ্রীনিকেতন হোটেলের ওপরে। অবশ্য এটির নতুন নাম হয়েছে ‘হোটেলিআর অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’।
শক্তিদার হাতের কাজ শেষ হলে আনন্দবাজার থেকে বেরিয়ে আমরা দুজন হেঁটে হেঁটে চলে আসতাম শ্রীনিকেতনে ও কোনো কোনো দিন বউবাজার মোড়ে।
শক্তিদা প্রায় দিনই অনেকক্ষণ থাকতেন আমার ওখানে এবং কখনো কখনো ইচ্ছা হলে কিছু সময় ঘুমিয়েও নিতেন। তারপর সন্ধ্যার আগে হোটেল থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম কলেজ স্ট্রিটে। সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ‘কফি হাউসে’ বসা এবং কোথা থেকে যে তখন সময় কেটে যেত বুঝতে পারতাম না। কফি হাউসে অনেক দিন শরৎ-সুনীলসহ আরো অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং আড্ডা হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। সেসব দিনের কথা এখনো পরিষ্কার মনে আছে।
শক্তিদাকে নিয়ে অনেক ঘটনার সাক্ষী আমি। আমি তাকে যতটা দেখেছি, তাতে আমার কেন যেন মনে হয়েছে শক্তি-সুনীলের মধ্যে কোথায় যেন একটা অদৃশ্য টান ছিল এবং সুনীলদাকে দেখতাম, প্রায় সময়ই শক্তিদার অনেক খামখেয়ালিপনা হাসিমুখে মেনে নিতেন। এই ব্যাপারটা অন্য কারোর বেলায় ঘটত না। হয়তো সে কারণেই আমার বারবার মনে হতো শক্তিদা ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা, অন্য রকম মানুষ ও অসাধারণ এক কবি, যিনি সব সময় কবিতাকে কাব্য বা কবিতা না বলে, বলতেন পদ্য ও যিনি লিখে গেছেন।
১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় তার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব’ এই কাব্যগ্রন্থটি তাকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল এবং এই বছরই তিনি পেয়েছিলেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার।
মনে আছে, অন্যান্য দিনের মতো এই রকম একদিন সন্ধের দিকে হোটেল থেকে বেরিয়ে দুজন হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম কলেজ স্ট্রিটে। সেই দিন শক্তিদা কী ভেবে হঠাৎ ‘ভারবি’তে ঢুকে সেখান থেকে প্রকাশিত তার তিন খানা কবিতার বই- ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’, ‘সোনার মাছি খুন করেছি’ এবং ‘হে প্রেম, হে নৈঃশব্দ’ আর ‘চলো বেড়িয়ে আসি’ নামের একখানা ভ্রমণবিষয়ক বইয়ে আমার নাম লিখে আমার হাতে দিয়ে দিয়েছিলেন। আজ শক্তিদা নেই, কিন্তু তার দেওয়া সেই চারখানা বই তার স্মৃতি নিয়ে আমার কাছে এখনো রয়ে গেছে। সেগুলোই এখন স্মৃতি বহন করছে অনেক ঘটনার।