দেশভাগের সময় যে কয়েকজন শিল্পী কলকাতা থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন তাদের মধ্যে একজন শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ। তার জন্ম ১৯২২ সালের ২০ জুন কলকাতার ভবানীপুরে। চারুশিল্পে শিক্ষা নিয়েছেন কলকাতা আর্ট স্কুলে ১৯৩৬ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। দেশে তীব্র অভাব। দুর্ভিক্ষে মানুষ মারা যাচ্ছে। শিল্পী জয়নুল আবেদিনের তুলিতে মূর্ত হয়ে উঠছে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের ছবি। অর্থকষ্ট, দরিদ্রতা, যুদ্ধ, পারিবারিক সংকট কোনো কিছুই তাকে থামাতে পারেনি, সেসবকে উপেক্ষা করে তিনি চ্যালেঞ্জ নেন টিচার শিপ কোর্স শেষ করার। এ সময় কলেজেরই এক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে জিতে নেন প্রেসিডেন্ট স্বর্ণ পদক এওয়ার্ড।
বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী ও নারী নেত্রী মালেকা বেগমের সঙ্গে আশির দিকে এক কথোপকথনে তার জীবনের গল্প বলতে গিয়ে শিল্পী নিজে বলছেন, ‘অর্থাভাবে দারুণ কষ্ট পাচ্ছি। ১৯৪৫ সাল। কলেজেরই এক প্রদর্শনীতে আমার ছবি দিয়েছি। অবাক কা- ঘটে গেল, আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যে একাডেমির প্রেসিডেন্ট পুরস্কার স্বর্ণ পদকটি পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে! এরপর আমার কপাল খুলে গেল। আমার আত্মীয়স্বজনের কাছে বেশ মর্যাদা পেলাম। এর পরপরই দিল্লি ও পাটনার প্রদর্শনীতে ছবি দিয়ে পুরস্কার পাই।’
এই পুরস্কারটি ছিল পাটনার শিল্পকলা পরিষদের ‘দ্বারভাঙ্গা’ মহারাজার স্বর্ণ পদক। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে শিল্পী সফিউদ্দিন চলে আসলেন ঢাকায়। ১৯৪৫ থেকে ’৪৭ সালকে তিনি বলেছেন তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। শিল্পকলা প্রসঙ্গে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতিÑ‘নিরবচ্ছিন্ন সাধনা ছাড়া ছবি আঁকার বিষয়টি নিরর্থক হয়ে যায়। ছবি আঁকার বিষয়টি যারা বোঝে না, তাদের নানা রকম অভিব্যক্তি আছে, যা একজন শিল্পীকে হতাশ করতে পারে। ছবি আঁকাটা তুলির টান ছাড়া কিছু নয় বলেই সাধারণ ধারণা। কিন্তু এ তো তারও বেশি। এই তুলির টান দিতে আর্টিস্টকে দীর্ঘ একাডেমিক শিক্ষার স্তর পেরিয়ে আসতে হয়। শুধু ছবি আঁকার জন্য হলেও আর্টিস্টকে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ করতে হয়। পড়াশোনার মধ্য দিয়েও জানা-বোঝার জগৎকে পরিমার্জিত করতে হয়।’ ’৪৭ পরবর্তী ঢাকার সুদীর্ঘ জীবন নিজেকে নির্মাণ করার আজীবন সাধনা তাকে নিয়ে গেছে অনন্য মাত্রায়। তিনি চিত্রশিল্পের সাধক পুরুষ। বহিরাঙ্গে তিনি শান্ত সমাহিত নিরীহ নিভৃতচারী অরাজনৈতিক অসংগ্রামী নানা বিশেষণ পেলেও প্রকৃতার্থে তিনি তার অভীষ্ট লাভে ছিলেন দারুণ জেদি ও লড়াকু। জীবনসংগ্রাম ও শিল্পের তপস্যায় যা তিনি বারবার প্রমাণ রেখে গেছেন। বিচ্ছিন্ন হননি শিল্পের সাধনা থেকে আমৃত্যু। আত্মপ্রচার আত্মতুষ্টি, অহংকার তাকে স্পর্শ করতে পারেনি কখনো। তার জীবন পাঠ শিল্পীদের জন্য অনুসরণীয়।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh