আবুবকর সিদ্দিক: স্থবির চেতনার বিরুদ্ধে

আবুবকর সিদ্দিক (১৯ আগস্ট ১৯৩৪-২৮ ডিসেম্বর ২০২৩) আয়নায় পড়া সেই প্রতিবিম্বকে চিনতেন। তাই তার আপন সন্ন্যাসে থেকেও তিনি গদ্য-পদ্যের বিপুল ভান্ডার বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়েছেন। ‘আমার সকল রসের ধারা’- দুই খণ্ডে প্রকাশিত কবিতাসংগ্রহের কবি আবুবকর সিদ্দিকের প্রথম কবিতার বই ‘ধবল দুধের স্বরগ্রাম’ প্রকাশ পায় ১৯৬৯ সালে। এর প্রায় সাত বছর পর ১৯৭৬ সালে দ্বিতীয় কবিতার বই ‘বিনিদ্র কালের ভেলা’।

তারপর ১৯৮৪ সালে ‘হে লোকসভ্যতা’। এরপর নিয়মিত বিরতিতে প্রকাশ পেয়েছে- মানুষ তোমার বিক্ষত দিন, হেমন্তের সোনালতা, নিজস্ব এই মাতৃভাষায়, কালো কালো মেহনতী পাখি, কংকালে অলংকার দিয়ো, শ্যামল যাযাবর, মানব হাড়ের হিম ও বিদ্যুৎ, মনীষাকে ডেকে ডেকে, আমার যত রক্তফোঁটা, শ্রেষ্ঠ কবিতা, কবিতা কোব্রামালা, বৃষ্টির কথা বলি বীজের কথা বলি, এইসব ভ্রুণশস্য, বাভী, নদীহারা মানুষের কথা। শেষ কবিতার বই- নদীহারা মানুষের কথা প্রকাশ পায় ২০০৮ সালে। ছড়াগ্রন্থ হট্টমালা প্রকাশ পায় ২০০১ সালে। কবি ও গণসংগীত রচয়িতা আবুবকর সিদ্দিক ‘জলরাক্ষস’, ‘খরাদাহ’, ‘বারুদপোড়া প্রহর’ এবং ‘একাত্তরের হৃদভস্ম’ নামে চারটি উপন্যাসেরও রচয়িতা। জলরাক্ষস প্রকাশ পায় ১৯৮৫ সালে। উপন্যাসের শুরুতে কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান ‘শুভবার্তা’ শিরোনামে লিখেছিলেন, ‘আবুবকর সিদ্দিক বাংলাদেশের সাহিত্য-প্রাঙ্গণে নবাগত কেউ নন। কবি হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত। কিন্তু গদ্য-রচনা তাঁর নিকট দুয়োরানি নয়। গল্প কম লেখেননি। কিন্তু পুস্তকারে এ পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি আজও। উপন্যাস অবশ্য তিনি লিখেছেন। এতদিনে

পুস্তকাকারে ‘জলরাক্ষস’ বেরোচ্ছে, আমি তার জন্যে বিশেষ আনন্দিত। কারণ পত্রিকায় যখন উপন্যাসটি ছাপা হয়, তখনই পাঠকমহল নড়ে উঠেছিল। তার চেয়েও বেশি নড়ে উঠেছিল কর্তৃপক্ষ- শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার ভার যাদের হাতে ন্যস্ত। শেষ পর্যন্ত ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে সামারি ট্রায়ারে আসামিরূপে লেখককে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল, সসম্মানে তিনি মুক্তি পান। 

‘জলরাক্ষস’ প্রকাশের দুই বছর পর, অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে প্রকাশ পায় খরাদাহ। খরাদাহ উপন্যাসটি প্রথম পরিচ্ছেদের রচনাকাল জুন ১৯৭৯। এই অংশটি ১৯৮৩ সালে সাপ্তাহিক রবিবারের ঈদসংখ্যায় ‘খরাযাত্রী’ নামে প্রকাশ পায়। পরের, দ্বিতীয় থেকে চতুর্দশ অধ্যায় পর্যন্ত রচনাকাল ডিসেম্বর ১৯৮৪। এই পুরো অংশটি ১৯৮৫ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদসংখ্যা ‘খরাদাহ’ নামে প্রকাশ পায়।

পরের দুটি উপন্যাসের প্রকাশকাল যথাক্রমে ১৯৯৬ ও ১৯৯৭। আবুবকর সিদ্দিক তার প্রথম দুটি উপন্যাসের শুরুতেই উদ্ধৃত করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। এর পেছনেও রয়েছে আবুবকর সিদ্দিকের সাহিত্যিক উদারতা। পাঠক হিসেবেও তার যে সুনাম, সেই সুনামের যথাযথ ব্যবহার তিনি করেছেন। সাহিত্যের শুধু ঘনিষ্ঠজনদেরই নয়, তরুণতম কারো লেখার প্রতিও পাঠমুগ্ধতার কথা তিনি অকৃত্রিমভাবে জানিয়েছেন। আর কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিল তার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। আবুবকর সিদ্দিক গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তখনই তার সঙ্গে ‘সন্দীপন গোষ্ঠীর’ সম্পৃক্ততা গড়ে ওঠে। ত্রিশের দশকের পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম কবি বিষ্ণু দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে। বন্ধুত্ব হয় পঞ্চাশের দশকের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ১৯৬৩ থেকে ১৯৯৫ সালে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের বন্ধুত্বের বর্ণনা পাওয়া যায়, আবুবকর সিদ্দিকের আত্মজৈবনিক গদ্য ‘শক্তিসঙ্গ শক্তিপ্রসঙ্গ’-এ। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত ‘পূর্ণতা’ (জুলাই ১৯৯৬) নামের পত্রিকার স্মরণসংখ্যায় তিনি লিখেছেন, ‘শক্তির কবিতা আমাকে আঁকশীর মতো টানে। পড়তে পড়তে আমি একটা আলাদা জগতে অবলীলায় প্রবেশ করি। পাঠককে এভাবে অধিকার করতে পারা বড় কবির কাজ। শক্তির কবিতা পাক দিয়ে ফেরে মাথার মধ্যে। তার উপমা আর প্রতীকগুলো এক যাদুযানে তুলে নিয়ে যায় বিশুদ্ধ কোনো কষ্টের আকাশে। তার শব্দ আর চরণ আমি আমার লেখায়ও উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করতে ভালোবাসি।’

 আবুবকর সিদ্দিক গণমানুষের সংগ্রামী চেতনা, তাদের অধিকারের প্রশ্নে বরাবরাই সজাগ ছিলেন। মানুষের প্রতি অদম্য টান তাকে ভালো-মন্দ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন করেছে। ফলে নিজের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার আবেগী উত্তাপ ছড়িয়ে রয়েছে তার সাহিত্যে। সচেতনভাবে না হলেও মানুষ যে অবচেতনেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যায়, যেতে বাধ্য হয়, মানুষ ও রাজনীতি যে বিচ্ছিন্ন কোনো অনুষঙ্গ নয়, সেই সত্যটি খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন আবুবকর সিদ্দিক।

ফলে কি তার ছোটগল্প, কি গণসংগীত, কি উপন্যাস অথবা কবিতা-কোথাও তিনি এ দুইকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করেননি। করার চেষ্টাও করেনি। বরং এ দুইয়ের নিবিড় পরিচয়ের সূত্রটিকেই স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থাপন করেছেন। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ তার উপন্যাস ‘জলরাক্ষস’, ‘খরাদাহ’ এবং তার রচিত অসংখ্য ছোটগল্প। ‘ভূমিহীন দেশ’, ‘চরবিনাশকাল’, ‘মরে বাঁচার স্বাধীনতা’, ‘কুয়ো থেকে বেরিয়ে’, ‘ছায়াপ্রধান অঘ্রাণ’ নামের তার ছোটগল্পের বইয়ের নামগুলোও সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়। খুলনা-বাগেরহাট অঞ্চলের নি¤œভূমির মানুষের জীবন সংগ্রাম, তাদের ভেতরে জমতে থাকা ক্রোধ-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ‘জলরাক্ষস’।

অন্যদিকে কর্মক্ষেত্র বরেন্দ্র অঞ্চলের সঙ্গে গড়ে দিয়েছিল আত্মিক বন্ধন। খরাপীড়িত প্রকৃতির রুক্ষ-রুদ্র রূপের কাছে অসহায় মানুষের জীবনালেখ্য ‘খরাদাহ’। উপন্যাসের জন্য যে কয়টি বিষয় প্রাসঙ্গিকভাবে সামনে এসে দাঁড়ায়Ñতাতে কাহিনি, ভাষা, চরিত্র অন্যতম। দুটি উপন্যাসেই সেই সামনে এসে দাঁড়ানো বিষয়গুলোর যথাযথ মর্যাদা তিনি দিয়েছেন। শওকত ওসমানের সেই আশীর্বাদবাণী মনে রেখেছেন। সস্তা জনপ্রিয়তা না খুঁজে, নিজেকে আড়ালে রেখেই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে দেখিয়েছেন ভাষা ও শব্দের প্রতি তার অনায়াস দক্ষতা। সে শুধু ভাষা ও শব্দেরও কসরত নয়, তাকে রয়েছে বাংলাদেশ ও মানুষের জীবন ছবি, মুক্তিকামী মানুষের হার্দিক উপস্থিতি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh