গ্রামীণ বিয়ের সংস্কৃতি

গ্রামীণ বিয়ে আনন্দে ভরা এক উৎসব। এই আনন্দ এক দিনের নয়। ঘটনাও অল্প সময়ের নয়। অর্থনৈতিক অবস্থা যেমনই হোক, গ্রামীণ বিয়ের সংস্কৃতি এক অনন্য বিষয়। সাধারণত বিয়ের দিন বা আগের দিন আয়োজন করা হয় গায়েহলুদ ও মেহেদী পড়ানোর অনুষ্ঠানের।  বিয়ের গীত বা গান বর-কনের সম্মানে গাওয়া হয়। গ্রামে গায়েহলুদ মানেই খুশি, আনন্দ ও ঠাট্টা সম্পর্কীয়দের সঙ্গে রং আর কাদা মাখামাখি খেলা। কারো বাগান থেকে তুলে আনা গাঁদা ফুল, কুলায় রাখা ধান-দুর্বা, কাঁচা হলুদ, মেহেদী, গিলা বাটা নিয়ে বর বা কনেকে জলচৌকিতে বসানো হতো। পাড়ার মহিলা, কম বয়সী মেয়েরা পাটায় মেহেদী বাটার সময় গীত বা গান ধরত। আগে থেকেই ‘গীতগাওনি’দের খবর দিয়ে গায়ে হলুদের দিন গীত গাওয়ার জন্য বলেকয়ে রাখা হতো। প্লাস্টিকের সিরিঞ্জভর্তি কুনিরং, যা মাথায় বা গায়ে একবার লাগলে সারাক্ষণ রং বেরিয়ে এসে শরীর কাপড় রঙে রঙিন হয়ে যেত। কেউবা পুকুর বা জলাশয় থেকে বদনা ভর্তি কাদা উঠিয়ে আনত। ঠাট্টা সম্পর্কের যারা বেয়াই, বেয়াইন, দেবর, ভাবি, দাদা-দাদিদের মুখে শরীরে জোর করে কাদা ও হলুদ মাখিয়ে দিতে পিছু পিছু দৌড়ে যেতেন। এ নিয়ে অনেক সময় ভুলবোঝাবুঝি হতো, যা মন খারাপের অনুষঙ্গ হয়ে দীর্ঘদিন কথা বলা বন্ধ থাকত। বর বা কনেকে হলুদ মেহেদি পড়ানোর সময় গায়ে হলুদের গীত বা গান ধরত মেয়েরা। এই গীত ছিল বিয়ে অনুষ্ঠানের প্রাণ।

‘অলদি বাডি মেন্দি গিলা/আইজ কইন্যার বিয়া/আইব জামাই মাইজ রাইত/গরুর গাড়ি দিয়া।’

বাড়ির উঠানে মহিলা, মেয়েরা গোল হয়ে সবাই হাত ধরাধরি করে ঘুরে ঘুরে বিয়ের গীত গাইত। আপু, ভাবি, দাদিসহ পাড়ার মহিলারা গান ধরত, চারপাশ থেকে দলবেঁধে ঘিরে রাখত শিশুরা। এসব গান কোথাও লেখা 

থাকত না। সবাই মুখে মুখে গেয়ে মুখস্থ করে রাখত। বিয়ের গীত রচনায় ছিলেন গ্রামের অজপাড়াগাঁয়ের নিরক্ষর মহিলারা, পরিবেশনও তারাই করতেন। নারী মনের আবেগ, উৎকণ্ঠা, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার প্রকাশ ছিল বিয়ের গীত বা গানজুড়ে। দাম্পত্য জীবনের হাসি-ঠাট্টা, পরস্পরকে চেনাজানা, দুঃখ, আনন্দ মিশে থাকত এসব গানে। বাঙালি সংস্কৃতিতে লোকসংগীতের যে কয়টি ধারা লোকসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে, তার মধ্যে বিয়ের গীত অন্যতম। প্রাচীনকাল থেকেই বিয়ের গীত চলে আসছে আনন্দ ও চিত্তবিনোদনের অনুষঙ্গ হয়ে। দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা ও কৌতুকের অংশই হলো বিয়ের গীত।

জামাই আসার পথে সারা রাস্তায় সাধারণ পোশাক পরে এসে শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি কোথাও জামাইয়ের পোশাক পরে। তখন মধ্যরাত। কনের বাড়ির সামনে কলাগাছের গেটে আটকে দেওয়া হয় জামাইকে। গেট পাস বাবদ নির্দিষ্ট টাকা দিয়ে তারপর যেতে হবে তাকে। শুরু হয় বর ও কনে দুই পক্ষের ছেলেমেয়েদের তর্কাতর্কি। নিয়ম হলো যারা যারা গেট সাজানোর কাজে ও বাড়ির সমবয়সী তারাই পাবে জামাই থেকে প্রাপ্ত টাকা।

‘জামাই আইছে করত বিয়া/লগে এরা কেবা/বিয়া বাইত জামাই উবা/লগে আমরা শোভা।’

বিয়ের এজিন নিতে কবুল বলতে অনেক দেরি করে গ্রামের মেয়েরা। কও মা কবুল, কও মা কবুল- সবাই চারদিক থেকে অনুরোধ করতে করতে কনে কবুল বলে। এক পর্যায়ে শাহনজরে আয়নায় মুখ দেখতে বলা হয়। তারপর কনেকে জামাইয়ের বাড়িতে যেতে বিদায় দেওয়া হতো। কান্নাকাটি শুরু হয়ে যেত তখন। কনে বরকে জিজ্ঞেস করে জানতে চায়, বর তাকে ভাতের কষ্ট দিবে কি? তখন গীত গাইত মেয়েরা- ‘ছোট্ট থাইকেয়া করল বড়/মা-বাবা যারে/সেই মেয়েটা পর হইয়া/যায় যে শ্বশুরঘরে।’

এভাবেই বেঁচে থাকত গ্রামীণ আচার অনুষ্ঠান। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা বিয়েতে নারীদের গান, তথা বিয়ের গীত পরদেশে থাকা স্বামীর সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিরহ নারীকে কষ্ট দিত। তবুও জীবন কেটেছে, কাটাতে হয়েছে, মনের ইচ্ছাগুলোকে বিষলক্ষার ছুরির আঘাতে মেরে। তখন বিদ্যুৎহীন গ্রামীণ জনপদ। সহজ-সরল গ্রামের মানুষের মন ছিল, একে অপরের বিপদ-আপদে এগিয়ে আসার সদভাব ছিল। মাটির সানকি বা কলাপাতায় খিচুরি খেয়ে অমৃতের স্বাদ পেত মানুষ। এখনো বিয়ে বাড়িতে গ্রামের সবাই এগিয়ে আসে, একে অপরের ভাই, স্বজন হয়ে। এখন বিদ্যুতে ফকফকা রাতের গ্রাম। ছনের, টিনের ঘর ছেড়ে দালান ঘর বানিয়েছে মানুষ। বিনিময়ে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি, বিয়ের গান এখন সেকেলে হয়ে গেছে-আজকের প্রজন্মের কাছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh