রফিকুন নবী: যার শিল্প নির্মিত হয়েছে মানুষের জন্য

দীপান্ত রায়হান
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৫৩

রফিকুন নবী। ফাইল ছবি
গত শতাব্দীর ষাটের দশক। ভারত উপমহাদেশজুড়ে রাজনৈতিক বাঁকবদলে নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। শত বছরের শৃঙ্খল ভেঙে উপমহাদেশের রাজনীতি উন্মুক্ত হতে শুরু করেছে গণমানুষের জন্য। বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান নামের এক ভূখণ্ড, যার অধিবাসীরা নিত্য লড়াই করছে এক সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে। এমন প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবাংলা থেকে সম্প্রচারিত ‘আকাশবাণী’ বাংলাভাষীদের জন্য বিশ্ব সংবাদের বিশ্বস্ত মাধ্যম হয়ে উঠেছে। সীমানা পেরিয়ে পূর্ববাংলার মানুষদের কানে পৌঁছে দিচ্ছে সংবাদ-সংস্কৃতির নানান অনুষঙ্গ। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় নামটি তখন ‘আকাশবাণী’র শ্রোতাদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। তার কণ্ঠে প্রচারিত হচ্ছে প্রতিবাদী ছড়া-কবিতা, তথ্যকণিকা ও সংবাদ বিশ্লেষণ।
আকাশবাণীতে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সম্প্রচারিত ছড়া-কবিতার অধিকাংশ ছড়াকার, কবি ছিলেন দুই বাংলার প্রতিষ্ঠিত নবীন-প্রবীণ লিখিয়ে। হঠাৎই সেই লেখকদের সঙ্গে শোনা গেল রফিকুন নবীর নাম। তার নামে মাঝেমধ্যেই প্রতিবাদী ছড়া প্রচারিত হচ্ছে। ঢাকার লেখকরা চেনেন না নতুন ছড়াকার রফিকুন নবীকে। ছড়া শুনে অনেক মুগ্ধ লেখক-পাঠক এই ছড়াকারের সন্ধান করে চলেছেন। কেউ কেউ অনুমান করছেন এই ছড়াকার হয়তো শিল্পী রফিকুন নবী হয়ে থাকবেন। তত দিনে রফিকুন নবী অলংকরণশিল্পী ও চিত্রকর হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তার নাম উচ্চারিত হয় বেশ সম্মানের সঙ্গে। কিন্তু তার খ্যাতি কার্টুন এবং চিত্রশিল্পের জন্য। তার লেখার সঙ্গে কেউ পরিচিত নন। একদিন খ্যাতিমান এই শিল্পীর অনুজ ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক সফিকুন নবী বিরাজমান দ্বন্দ্বের অবসান ঘটালেন। জানালেন রফিকুন নবী নামের সেই ছড়াকার আর কেউ নয়, তারই অগ্রজ শিল্পী রফিকুন নবী।
ভূমিকায় ঘটনাটি উল্লেখের মূল কারণ রফিকুন নবীর শিল্পীসত্তাকে নতুনভাবে জানার প্রচেষ্টা। একজন শিল্পী যে কারণে শিল্পী হয়ে ওঠেন তার নেপথ্যে থাকে নিরন্তর সাধনা ও প্রকাশব্যাপ্তির পরিমিতিবোধ। আবশ্যিকভাবে উল্লেখ্য, মানুষের প্রতি আর সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা। শিল্পমানোত্তীর্ণ শব্দটির গূঢ় অর্থ যখন টাচি, ক্যাচি আর পপুলার শব্দবন্ধে আটকে যাচ্ছে; রফিকুন নবীর মতো মহৎ শিল্পী তখন বিপরীত উদাহরণে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। ষাটের দশকের প্রতিবাদী ছড়া, সত্তর দশকের টোকাই আর ছয় দশকের বিবিধ অলংকরণ শুধু একজন শিল্পীর শিল্পী হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা নয়। এটাকে কেবল উৎকৃষ্ট শিল্প বা শিল্পীর টিকে থাকার লড়াই বললেও যথার্থ মূল্যায়ন হয় না। বরং মানুষের কল্যাণে শিল্প নির্মাণের বিপুল প্রয়াস। রফিকুন নবীর শিল্পীসত্তা উৎসারিত সেই প্রয়াসে।
টোকাই নামের যে কার্টুন সিরিজ বাংলাদেশের প্রায় চল্লিশ বছরের আর্থসামাজিক ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করেছে সেই কার্টুনকে মামুলি কার্টুন বলার যেমন সুযোগ নেই তেমনি শিল্পী রফিকুন নবীকে কেবলি আর্টিস্ট বললেও তার শিল্পসত্তার অবমূল্যায়ন করা হয়। তিনি সময়কে ধারণ করেছেন সময়ের প্রয়োজনে। মানুষের পক্ষে ছবি এঁকেছেন মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। এমন শিল্পী সময়ে ফুরিয়ে যান না। বেঁচে থাকেন অনন্তকাল।