আধুনিক বিশ্বের ভূতুড়ে শহর–মালয়েশিয়ার ‘ফরেস্ট সিটি’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮:৩৩

মালয়েশিয়ায় নির্মাণাধীন 'ফরেস্ট সিটি। ছবি: সংগৃহীত
"অবশেষে আমি সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিলাম," ভয়-মিশ্রিত হাসিতে কথাগুলো বললেন নাজমি হানাফিয়াহ। বছর খানেক আগে ৩০ বছর বয়সী তথ্য-প্রযুক্তি প্রকৌশলী নাজমি 'ফরেস্ট সিটি'র এক ব্লকে একটি বেডরুমের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বাস করতে শুরু করেন। তার বেডরুম থেকে দেখা মিলত সাগরের। চীনের একটি আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ মালয়েশিয়ার উপকণ্ঠে অবস্থিত জোহরে ফরেস্ট সিটি নামের এই আবাসিক এলাকাটি নির্মাণ করে। কিন্তু ছয় মাসেই নাজমি অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তার মনে আর সায় দিচ্ছিল না শহরটিতে থাকতে। এটিকে 'ভূতুড়ে শহর' হিসেবে বলছেন নাজমি।
তিনি বলেন, "আমি আমার জমানো অর্থ আর চলমান ডিপোজিট নিয়ে একবারও আর ভাবিনি। শুধু চেয়েছিলাম সেখান থেকে চলে আসতে।"
"সেখানে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবলে আমি এখনো আঁতকে উঠি। শহরটির চারদিক নিস্তব্ধ-নির্জন। শুধু আমি আর আমার চিন্তা ছাড়া এ শহরে আর কিছুই ছিল না"- এভাবেই তার মানসিক আতংকের বর্ণনা দিচ্ছিলেন নাজমি।
বলছিলাম মালয়েশিয়ার জহরে নির্মাণাধীন ফরেস্ট সিটি প্রকল্পের কথা। যেখানে রাত ঘনিয়ে আসলেই অন্ধকারের চাদরে ঢেকে যায় পুরো শহর। শহরটির প্রতিটা ব্লকে রয়েছে শত শত অ্যাপার্টমেন্ট, অথচ আধা ডজনের চেয়েও বেশি অ্যাপার্টমেন্টে দেখা যায় না সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলতে। এখানে আদৌ মানুষের বসবাস রয়েছে কী না, সেটি বিশ্বাস করাও অত্যন্ত কঠিন।
চীনের সর্ববৃহৎ আবাসন প্রতিষ্ঠান কান্ট্রি গার্ডেন এই ফরেস্ট সিটি শহরটির নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করে। ১০০ বিলিয়ণ ডলার (৭৮.৯ বিলিয়ন ইউরো) ব্যয়ে ২০১৬ সালে ঘোষিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় এই মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এসময় চীনের আবাসন শিল্প একেবারে ফুলে ফেঁপে ওঠে। এমনকি দেশি-বিদেশি মধ্যবিত্ত নাগরিকদের জন্য দৃষ্টিনন্দন আবাসন নির্মাণের পরিকল্পনার জন্য বিদেশি ঋণের প্রতিও ঝুঁকে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি।
মালয়েশিয়ায় ইকো-ফ্রেন্ডলি এই প্রকল্পে রয়েছে গলফ খেলার মাঠ, ওয়াটার পার্ক, অফিস, বার ও রেস্টুরেন্ট। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ফরেস্ট সিটিতে আট বছরের মধ্যে ১০ লাখ লোক বাস করতে পারবে এমন পরিকল্পনা থেকেই এই প্রকল্প নির্মাণ শুরু হয়েছিল। তারা জানায়, আপনি এখানে থাকলে অনুভব করবেন যেন চীনেই বাস করছেন। সম্প্রতি মাত্র পুরো প্রকল্পের মাত্র ১৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আর মাত্র ১ শতাংশ লোক এখানে বাস করতে শুরু করেছেন।
ইতোমধ্যে ফরেস্ট সিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কান্ট্রি গার্ডেনের ঋণ বর্তমানে ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছালেও প্রকল্পটি সম্পন্নের বিষয়ে তাদের আশাবাদ রয়েছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছে।
যেমনটা হওয়ার কথা ছিল 'ফরেস্ট সিটি'
'গা ছমছমে' পরিবেশ
ফরেস্ট সিটিকে 'মানবজাতির বসবাসের জন্য ড্রিম প্যারাডাইজ বা স্বর্গস্থান' হিসেবে একসময় উল্লেখ করা হতো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটিকে ঘিরে নির্মাতাদের লক্ষ্য ছিল এখানে চীনা স্থানীয় পণ্যের একটি শক্তিশালী বাজার তৈরি করা। যেটির মাধ্যমে তারা মূলত উচ্চাভিলাষী মানুষদের বিদেশে দ্বিতীয় একটি বাড়ির মালিক হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। কিন্ত এখানে একটি বাড়ির বিক্রয়মূল্য এত বেশি যে, মালয়েশিয়ার সাধারণ মানুষের জন্য তা থেকে যায় অধরা।
অন্যদিকে চীনা ক্রেতাদের কাছে এখানে জায়গা কেনা মানেই তাদের বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। কারণ নাজমির মতো স্থানীয় মালয়েশিয়ানদের কাছে তারা এসব অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দিতে পারবেন। ফরেস্ট সিটি নির্মাণ করা হয়েছে মালয়েশিয়ার অন্যতম একটি দ্বীপে যেটি দেশটির জোহর বাহরু থেকে বেশ দূরে অবস্থিত। ফলে এটির অবস্থান লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় সম্ভাব্য বাসিন্দাদের জন্য আকর্ষণীয় হতে ব্যর্থ হয়ে পড়ছে। এ কারণেই স্থানীয়রা শহরটিকে এখন 'ভূতুড়ে শহর' নামে ডাকে।
নাজমি বলেন, "সত্যিকার অর্থে স্থানটি ছিল যথেষ্ট আতঙ্কজনক। আমার অনেক প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু অবশেষে খারাপ অভিজ্ঞাতার মুখোমুখি হই। সেখানে আমার কিছুই করার ছিল না।"
ফরেস্ট সিটির পরিবেশ এতটাই অদ্ভূতুড়ে যেন দেখে মনে হয় এটি একটি পরিত্যক্ত রিসোর্ট। জন-মানবহীন এখানকার সৈকত হয়ে উঠেছে যত্নহীন শিশুর খেলার মাঠ আর পড়ে রয়েছে মরিচা ধরা গাড়ি। এমনকি কুমিরের ভয়ে এখানকার পানিতে সাঁতার কাটাও অসম্ভব। শপিংমলগুলোর সব দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট বন্ধ। আর কিছু নির্মাণাধীন এলাকা পুরপুরি ফাঁকা।
এখানকার এক বাসিন্দা জোয়ান কাউর বলেন, "স্থানটি ভূতুড়ে। এমনকি দিনে যখন সদর দরজার বাইরে আসি, দেখি, করিডোর অন্ধকার।"
তিনি আর তার স্বামী একটি টাওয়ার ব্লকের আটাশ তলায় ভাড়া নিয়ে থাকেন। কিন্তু পুরো ফ্লোরে তারা ছাড়া নেই কোনো বাসিন্দা আর তাই নাজমির মতো যত দ্রুত সম্ভব স্থানটি ত্যাগের কথা ভাবছেন।
"যারা এখানে জায়গা কিনেছে ও বিনিয়োগ করেছে, তাদের জন্য আমার দুঃখ হয়। আপনি যদি 'ফরেস্ট সিটি' লিখে গুগল করেন, তবে এখন যা দেখছেন, বাস্তবে সেখানে তেমন পাবেন না" বলে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
তিনি আরও বলেন, "মানুষকে যেমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, প্রকল্পটি তেমনই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তেমনটা হয়নি।"
চীনের যেসকল নাগরিকেরা এখানে জায়গা কিনেছেন, তাদের সঙ্গেও কথা বলা দুষ্কর। কষ্টসাধ্যে অবশেষে বিবিসি বেশ কয়েকজনের সঙ্গে পরোক্ষভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও অজ্ঞাত নামেও তারা মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ফরেস্ট সিটি নিয়ে বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। লিয়াওনিং প্রদেশের এক ক্রেতা এক পোস্টে লিখেন, "এটি বিভ্রান্তিকর। ফরেস্ট সিটি বর্তমানে ভূতুড়ে শহর। কোনোভাবেই এটি মানুষের বাসের যোগ্য নয়। এটি শহর থেকে অনেক দূরে, বসবাসের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাও এখানে নেই। এখানে গাড়ি ছাড়া চলাচল করা খুবই কঠিন।"
আরেকজন মন্তব্যে লিখেন, এখন তারা ভাবছেন কীভাবে তাদের বিনিয়োগ ফেরত পাওয়া যায়। তিনি লিখেন, ‘’ আমার বসবাসের ইউনিটটির দাম একদম কমে গেছে। আমি নির্বাক।‘’
নেই বিক্রি-বাট্টা
এক ধরনের হতাশা পুরো চীনজুড়ে বিরাজ করছে আর দেশটিতে আবাসন শিল্পে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খল অবস্থার। আবাসন শিল্পের সঙ্গে জড়িত নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো অধিক হারে ঋণ নেয়ায় চীন সরকার ইতোমধ্যে শঙ্কার মধ্যে পড়েছে। অবশেষে সরকার ২০২১ সালে ঋণের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মূলভাষ্য, "বাড়ি বসবাসের জন্য, ফটকাবাজির জন্য নয়।" তবে সরকারের এমন পদক্ষেপে অনেক কোম্পানি অর্থাভাবে বড় বড় প্রকল্প শেষ করতে পারছে না।
মার্কেটে নেই লোকসমাগম
অক্টোবরে কান্ট্রি গার্ডেনকে একই কারণে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ও মেলবোর্নের দুটো প্রকল্প ছেড়ে আসতে বাধ্য করা হয়েছিল। বলা হচ্ছে, স্থানীয় রাজনীতিও ফরেস্ট সিটির বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী। ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ চীনা ক্রেতাদের জন্য ভিসা বন্ধ করে দিলে দেশের মাটিতে বিদেশিদের জন্য শহর বানানোয় তার আপত্তি ছিল।
যে দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ অস্থিতিশীল, সে দেশে এ ধরনের মেগা প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা করায় উদ্যোক্তাদের প্রজ্ঞা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। যদিও মালয়েশিয়ার বর্তমান সরকারের নীতি ফরেস্ট সিটি প্রকল্পের প্রতি কিছুটা সহায়ক, তারপরেও একজন ভবিষ্যৎ ক্রেতার কাছে এটি অস্পষ্ট যে, সরকার এই সুবিধা কতদিন ও কী পরিসরে দিয়ে যাবে। এছাড়াও করোনা মহামারির চলাকালীন বিদেশে অর্থ ব্যয়ের ওপর চীন সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপের মতো কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যাও কান্ট্রি গার্ডেনের প্রকল্পের অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরির অন্যতম কারণ।
ফাঁকা বিপণী বিতান
এ প্রসঙ্গে কেজিবি ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি কনসালট্যান্টসের তান উই তিয়াম বলেন, "আমার মনে হয়, তারা প্রকল্পের বিষয়ে একটু তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।"
তিনি বলেন, "এটি এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প, যা বাস্তবায়নের শুরুতে অবশ্যই অর্থের যোগানের বিষয়টি নিশ্চিত দরকার ছিল।"
মূলত ফরেস্ট সিটিকে মালয়েশিয়া ও প্রতিবেশী সিঙ্গাপুরের মাঝে নতুন বিশেষ এক অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলাই প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম পরিকল্পনা ছিল, যা প্রকল্পটিকে স্থিতিশীল ও নিরাপদ করে তুলতে শহায়ক হবে। কিন্তু অর্থের যোগান না থাকায় এটি শেষ করা ও এখানে বসবাসের জন্য মানুষকে আকর্ষণ করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়েছে।
উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতা
যখন চীনের আআবসন সংকটের বিষয়টি সামনে আসে, তখন প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির একটি ক্লাসিক ঘটনা হিসেবে 'ফরেস্ট সিটি'র প্রসঙ্গ সবার সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। কিছু স্থানীয় বিষয় রয়েছে যা বর্তমান পরিস্থিতির জন্য কিছুটা দায়ী হলেও এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, দূরবর্তী ও নিরস জায়গায় হাজার হাজার অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করে মানুষকে সেখানে বসবাসের জন্য আকর্ষণ আসলেই সম্ভব নয়।
পর্যটক শূন্য সমুদ্র সৈকত
তবে ফরেস্ট সিটি ও চীনের শত শত প্রকল্পের ভাগ্যে আসলে কী ঘটবে, তা নির্ভর করছে চীন সরকারের ওপর। গত মাসে প্রকাশিত বেশ কিছু প্রতিবেদনে যেসব তথ্য দৃশ্যমান হয়েছে তাতে দেখা যায়, ডেভেলপার নিয়ে করা সরকারের প্রাথমিক তালিকায় অবশ্য স্থান পেয়েছে কান্ট্রি গার্ডেন কোম্পানিটি। তারা চীন সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পেতে তালিকায় স্থান পেলেও এ সহায়তার পরিমাণ ঠিক কতটা হবে তা কিন্তু অস্পষ্ট । তবে এতসবের পরও এখানে নাজমির মতো বাসিন্দাদের ফেরার তেমন সম্ভাবনা অবশ্য দেখছেন না অনেকেই।
সূত্র: বিবিসি