
ইরান ও পাকিস্তানের পতাকা। ছবি: ইন্টারনেট
গত ১৬ জানুয়ারি পাকিস্তানে হামলা চালিয়েছে ইরান। এর জবাবে ১৮ জানুয়ারি ইরানে পাল্টাহামলা চালায় পাকিস্তান। সেই ঘটনায় অন্তত ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে; যা নিয়ে দুই প্রতিবেশী দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়। তবে এ সংঘাত বড় পরিসরের যুদ্ধে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা কম বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এ হামলা-পাল্টাহামলা বেলুচদের আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামকে আবারও আলোচনায় এনেছে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরএনএ জানিয়েছে, সিস্তান-বেলুচিস্তানে পাকিস্তানের হামলায় ৯ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে তিন নারী ও চার শিশু রয়েছে। তারা কেউ ইরানের নাগরিক নন। এর আগে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে প্রথম হামলা চালায় তেহরান। তাতে অন্তত দুই শিশু নিহত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েল এবং ইরান সমর্থিত হামাসের মধ্যে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার মধ্যে এই হামলা পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলবে। তাদের মতে, পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ, অন্যদিকে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায় বলে অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেন।
ইরানের সামরিক বাহিনী বা রিভলিউশনারি গার্ড কোর ইরাক এবং সিরিয়ায় বিভিন্ন লক্ষ্যে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা চালানোর পরের দিনই পাকিস্তানে বিমান হামলা চালানো হয়। পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ মুশাহিদ হুসাইন সাইদের মতে, এ পদক্ষেপ পাকিস্তানের জন্য বিস্ময়কর ছিল। আপাতত দেখে মনে হচ্ছে, এটা ইরানের সামরিক বাহিনী রিভলিউশনারি গার্ড কোরের গোপন অভিযান এবং এটি অবশ্যই আরও বিস্তৃতভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্ক বরাবর অম্ল-মধুর। এতে স্থিতিশীলতা এসেছিল পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের শাসনামলে। ইমরান তেহরানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে সময় এই সম্পর্কের বেশ উন্নতিও হয়। তবে ক্ষমতা থেকে ইমরানকে অপসারণের পর এবং সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পশ্চিমাদের সমর্থনপুষ্ট রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় আসার পর সেই ধারাবাহিকতা আর থাকেনি।
হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা এমন একটি বিষয়, যা দুই দেশের জন্যই উদ্বেগের। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতের ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থান অটুট রয়েছে। আর ভারত বুঝতে পারছে, যে ঘটনা ঘটেছে, দেশগুলো নিজেদের আত্মরক্ষার্থে তা করেছে। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় চালানো ইরানের হামলার নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা দেখেছি, ইরান গত কয়েক দিনে তার প্রতিবেশী তিনটি দেশের সার্বভৌম সীমান্ত লঙ্ঘন করেছে। সুতরাং আমরা ওই সব হামলার নিন্দা জানাই।’
প্রসঙ্গত ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে ইরান। তাদের প্রক্সি ফোর্স হিসেবে লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। হামলায় জড়িয়েছে ইরান নিজেও। তারা পাকিস্তানে হামলার আগে সিরিয়া ও ইরাকে হামলা চালিয়েছে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশ্লেষণ বলছে, গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের মধ্যে ইরানের এসব পদক্ষেপ আঞ্চলিক উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। নিক্কেই এশিয়ার খবরে বলা হয়েছে, সম্ভবত আইএসএসের হামলার মতো ঘটনাগুলোর প্রতিক্রিয়ায় ইরান পাকিস্তানে হামলা চালিয়েছে। এদিকে ইরানসমর্থিত হুতিদের ওপর মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হামলা চলমান থাকায় সব মিলিয়ে আঞ্চলিক উত্তেজনা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন সিনিয়র ইরানি কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিক্কেই এশিয়াকে বলেছেন, ইরান পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছিল ইসলামাবাদ যেন তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় না করে। ইরান ও পাকিস্তানের বেলুচদের যৌথভাবে মোকাবিলার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তার দাবি, পাকিস্তানের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এসেছে ওয়াশিংটনের চাপে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনআরপিও বলছে, পাকিস্তান ও ইরান দুই দেশের জন্যই অভ্যন্তরীণ চাপও ছিল। পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের বিশ্লেষক আব্দুল্লাহ খান এনআরপিকে বলেন, ইরান পাকিস্তানে হামলা উদযাপনের পর ইসলামাবাদ প্রতিক্রিয়া না দেখালে সে দেশের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতো। আর সেই বিবেচনায় পাল্টাহামলা চালানো হয়েছে।
ইরান-পাকিস্তানের মধ্যে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। সীমান্তে পাকিস্তানের দিকে রয়েছে বেলুচিস্তান প্রদেশ। অপর পাশে রয়েছে ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশ। ইরানই প্রথম দেশ হিসেবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং বিদেশে পাকিস্তানের প্রথম দূতাবাসও ইরানে স্থাপন করা হয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সময় দুই দেশ পরস্পরকে সহায়তা করেছে এবং ভূ-রাজনীতিতে তারা ব্যাপকভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল। ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লব এবং পাকিস্তানে সৌদি অনুপ্রাণিত ওয়াহাবি ধারার ইসলাম চর্চা বাড়তে থাকলে ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়তে থাকে।
১৯৯০-এর দশকে পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতা এবং শিয়া ছায়াযুদ্ধে উসকানি দেওয়ার জন্য ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়। অন্যদিকে এই সময়ে কাবুলভিত্তিক তালেবান সরকারকে ইসলামাবাদের সমর্থন দেওয়া নিয়ে অস্বস্তি ছিল তেহরানের। ভারতের সঙ্গে ইরানের সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে পাকিস্তানের কৌশলগত মিত্রতা বাড়ানোর বিষয়টি দুই দেশকে পরস্পর থেকে আরও দূরে সরিয়ে দিয়েছে। ২০১৮ সালে ইরান যখন চাবাহার নামে দেশটির সমুদ্র বন্দরের একাংশের নিয়ন্ত্রণ নয়াদিল্লির হাতে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করে, তখন ইসলামাবাদ এটি নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানে এই বিষয়টিকে গোওয়াদার বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব কমিয়ে আনতে ভারত ও ইরানের একটি পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছিল। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে গোওয়াদার বন্দর। এত সব অবনতির মধ্যেও দুই দেশ বড় কোনো দ্বন্দ্বে জড়ায়নি। আবার তারা তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কখনো ব্যবহারও করেনি।
ইরানের যে সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে পাকিস্তান হামলা চালিয়েছে, ২০০০ সাল থেকে সেখানে সক্রিয় রয়েছে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি। বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন যা দীর্ঘদিন ধরে পৃথক বেলুচিস্তানের দাবিতে লড়ছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, পাকিস্তানকে এই হামলার মূল্য দিতে হবে। বেলুচ লিবারেশন আর্মি চুপ থাকবে না। আমরা এর প্রতিশোধ নেব, শেষ দেখে ছাড়ব। আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছি। এই আবহে ইরানও যে পাকিস্তানের হামলাকে ভালো চোখে দেখছে না, তা তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থানেই স্পষ্ট।
তবে ইরান অথবা পাকিস্তান বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অভিন্ন শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে তাদের বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রার সংঘাতে জড়ানোর আশঙ্কা কম। হামলা-পাল্টাহামলার পর উভয়পক্ষ নিজেদের অবস্থান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। যেখানে পরিস্থিতির ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণ কোনো পক্ষই চায় না বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইরানকে ‘ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ’ বলে অভিহিত করেছে এবং ‘যৌথ সমাধান খুঁজে বের করার’ প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে।