ট্রাম্পের শুল্কনীতির প্রভাব, চীনের রাস্তায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৫, ১১:২২

শাংডা ইলেকট্রনিক্সের সামনে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা।
যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর শুল্কনীতির জেরে চীনে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোর ভুক্তভোগী শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে এসেছে। বকেয়া বেতনের দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
রেডিও ফ্রি এশিয়ায় রবিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধ্য চীনের হুনান প্রদেশের দাও কাউন্টি থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সিচুয়ানের সুইনিং শহর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ইনার মঙ্গোলিয়ার টংলিয়াও শহর পর্যন্ত শত শত শ্রমিক রাস্তায় নেমেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা মাসের পর মাস বেতন পাননি। আবার কেউ কেউ শুল্কজনিত কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা থেকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত হয়েছেন।
সুইনিং শহরের শাংডা ইলেকট্রনিকস কারখানার সামনে শতাধিক শ্রমিক রবিবারও বিক্ষোভ করেছেন। এ সময় তারা “ধর্মঘট! ধর্মঘট!” বলে স্লোগান দেন। এই দৃশ্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে শেয়ার দেন চীনা আন্দোলন পর্যবেক্ষনকারী অ্যাকাউন্ট ইয়েস্টারডে বিগক্যাট।
শ্রমিকদের ভাষ্য অনুযায়ী, সার্কিট বোর্ড উৎপাদনকারী সিচুয়ান-ভিত্তিক শাংডা ইলেকট্রনিকস বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের কোনো বেতন দেয়নি। এমনকি জুন ২০২৩ থেকে তাদের সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধাও বন্ধ রয়েছে।
এ ছাড়া গত ২৪ এপ্রিল হুনানের দাও কাউন্টিতে গুয়াংশিন স্পোর্টস গুডসের শত শত শ্রমিক ধর্মঘটে যোগ দেন। কোম্পানির কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও তারা ক্ষতিপূরণ ও সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হন।
শ্রমিকদের অভিযোগ, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে গুয়াংশিন ৫০ বছরের বেশি বয়সী শতাধিক নারী কর্মীকে ‘অবসরের বয়স হয়েছে’ অজুহাতে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করেছে। অথচ বেতন ও অবসরের কোনো দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কোম্পানির একজন পুরুষ কর্মচারী ‘সংবাদকর্মী’ শুনেই ফোন কেটে দেন। তবে দাও কাউন্টির শ্রম ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যুরো রেডিও ফ্রি এশিয়াকে (RFA) জানায়, “গুয়াংশিন স্পোর্টস গুডসে এখনও ডজনখানেক কর্মচারী কাজ করছে।”
অন্যদিকে ২৫ এপ্রিল, ইনার মঙ্গোলিয়ার টংলিয়াও শহরের জিনকান রয়্যাল গার্ডেন কমিউনিটির নির্মাণ শ্রমিকরা ছাদে উঠে বিক্ষোভ করেন। তারা হুমকি দেন, বকেয়া বেতন না পেলে ভবন থেকে লাফ দেবেন। ইয়েস্টারডে বিগক্যাট এই ঘটনারও একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে।
যে কারণে এমন পরিস্থিতি
এ অবস্থার পেছনে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস-এর তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর গড়ে ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করায় চীনে অন্তত ১ কোটি ৬০ লাখ শ্রমিকের চাকরি ঝুঁকিতে পড়েছে।
এক বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে গোল্ডম্যানের অর্থনীতিবিদ সিংচুয়ান চেন ও লিশেং ওয়াং লিখেছেন, “এই শুল্ক বৃদ্ধির কারণে চীনা অর্থনীতিতে গুরুতর চাপ পড়বে। ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশটির শ্রমবাজারে, বিশেষত রপ্তানিমুখী শিল্পখাতে, আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
তাদের মতে, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে যোগাযোগ যন্ত্রাংশ খাত, এরপর রয়েছে পোশাক ও রাসায়নিক শিল্প।
অর্থনৈতিক চাপ ও গভীরতর সংকট
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রমিক বিক্ষোভ বেড়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে কোম্পানিগুলোর দুর্বল ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য যুদ্ধ এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক চাপ।
বেইজিংভিত্তিক শ্রম অধিকার কর্মী জি ফেং, যিনি ১৯৮৯ সালের তিয়ানানমেন স্কয়ার বিক্ষোভের অন্যতম নেতা ছিলেন, বলেন, “সম্প্রতি আমি যেসব ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা করেছি, তাদের অনেকে ব্যবসার মন্দা ও নগদ অর্থের সংকট নিয়ে হতাশ।”
কারণ চীনের কোম্পানিগুলোকে ধার করে হলেও শ্রমিকদের বেতন দিতে হয়। অন্যথায় সরকার মালিকদের গ্রেপ্তার করতে পারে। রেডিও ফ্রি এশিয়াকে জি ফ্যাং বলেন, “কিছু মালিক বলেই দিয়েছেন, তারা জেলে যেতে রাজি, কিন্তু আর ব্যবসা চালাতে চান না।”
তবে জি আরও মনে করিয়ে দেন, শ্রমিক বিক্ষোভ চীনের জন্য নতুন নয়। তিনি বলেন, “করোনার পর থেকেই চীনের অর্থনৈতিক পরিবেশ খারাপ হওয়ায় এসব ঘটনা বাড়তে থাকে।”
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ফ্রিডম হাউসের ‘চায়না ডিসেন্ট মনিটর’-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে চীনে হওয়া অধিকাংশ বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছেন শ্রমিকরা। সংগঠনটির মতে, ওই সময় পর্যবেক্ষণ করা প্রতিবাদের ৪১ শতাংশ ঘটিয়েছে শ্রমিকরা, যাদের অভিযোগ ছিল বকেয়া বেতন, বন্ধ হওয়া আবাসন প্রকল্প বা জমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত ইস্যু নিয়ে।
তাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চীনে নথিভুক্ত প্রায় তিন-চতুর্থাংশ প্রতিবাদই অর্থনৈতিক ইস্যুভিত্তিক।