
চীনের উত্তর-পশ্চিম শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিম সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বাস। তাদের ওপর চালানো অত্যাচার নিয়ে সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে চীন।
বিশেষ করে দুটি ঘটনায় উইঘুরদের ওপর নির্মম অত্যাচারের খতিয়ান উঠে এসেছে বিশ্ব প্রচারমাধ্যমে। এর একটি হলো- জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উইঘুর নারীদের জোরপূর্বক বন্ধ্যত্ব করে দেয়া। অন্যটি হলো- সম্প্রতি মানুষের চুলে তৈরি ১৩ টন পণ্য জব্দ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস ও সীমান্তে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি উইঘুরদের দেহ থেকে জোরপূর্বক চুল সংগ্রহ করে এসব পণ্য তৈরি হয়েছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
এই দুই ঘটনাই ছাপিয়ে গেছে আধুনিক যুগে সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধী ও আদিবাসীদের ওপর নির্যাতনের সব ইতিহাসকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সাথে যা হচ্ছে, তা গণহত্যা ছাড়া আর কিছুই না। কৌশলগতভাবে সবচেয়ে পরিশীলিত ‘গণহত্যা’ এটি। একটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সমূলে ধ্বংস করার চেষ্টা। এই সংখ্যালঘু জাতিসত্তার নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং জীবনাচরণ নির্মূলের উদ্দেশ্যে তাদের বন্দিশিবিরে আটকে রাখছে।
বন্দিশিবিরগুলো বিশ্ব প্রচারমাধ্যমে ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ নামে পরিচিত। আর এমন নির্যাতন-নিপীড়নের মূল উদ্দেশ্য ‘জাতিগত গণহত্যা’।
১) নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষ হত্যা, ২) তাদের গুরুতর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি, ৩) নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষকে শারীরিকভাবে অক্ষম করে দিতে তাদের জীবনচর্চায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য করা, ৪) জন্মহার কমাতে শাসকের জোর ব্যবস্থা গ্রহণ, ৫) গোষ্ঠীর শিশুদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের আলাদাভাবে গড়ে তোলার প্রয়াস- এগুলোর যেকোনো একটি পদক্ষেপই গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত হয়।
উইঘুর জনগণের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করতে চীন সরকার ইচ্ছাকৃত ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে উল্লিখিত সব পদক্ষেপই গ্রহণ করেছে বলে ফরেন পলিসির একটি সাম্প্রতিক নিবন্ধে উঠে এসেছে।
ওই নিবন্ধে লেখক রায়হান আসাত ও ইয়োনা ডায়মন্ড জানিয়েছেন, চীনের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোয় বন্দি আছেন ১০ লাখের বেশি উইঘুর। নির্যাতন অব্যাহত থাকার পাশাপাশি করোনাভাইরাসের লকডাউনের মধ্যেও তাদের জোর করে বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনতে চালানো হচ্ছে বন্দিদের ওপর নির্যাতন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ক্যাম্পের বন্দিদের চীনের মান্দারিন ভাষা শেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অনুগত থাকতে, নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সমালোচনা বা সেই ধর্ম পরিত্যাগ করতে। উইঘুররা আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে নিজেদের সাংস্কৃতিক ও জাতিগতভাবে মধ্য এশিয়ার লোকজনের কাছাকাছি বলে মনে করেন। তাদের ভাষা অনেকটা তুর্কি ভাষার মতো। তাই শাসকশ্রেণির এ ধরনের নির্দেশ স্বাধীনচেতা উইঘুরদের জন্য মেনে নেয়া কঠিন। নির্দেশ অমান্যকারীদের শিকার হতে হচ্ছে নানা নির্যাতনের। তাদের ধর্ষণ, হত্যাও করা হচ্ছে।
তবে সৌভাগ্যবশত অনেকে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে অন্য দেশে চলে যেতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের বয়ানে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে অকথ্য নির্যাতনের চিত্র। তারা জানান, বন্দিদের বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। এছাড়া যখন তখন মারধর, মানসিক অত্যাচার করা হয়। অনেক সময় দেহে অজানা পদার্থ ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। আরো রয়েছে ওয়ারবোর্ডিং বা জলপীড়ন। এক্ষেত্রে বন্দিকে চিৎ করে শুইয়ে বেঁধে রেখে মাথা পিছনের দিকে হেলিয়ে দিয়ে মুখের ওপর অনবরত পানি ঢালা হয়। এতে মনে হবে যেন তিনি পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছেন। এই বন্দিশিবিরগুলো নির্মাণই করা হয়েছে উইঘুরদের শারীরিক, মানসিকভাবে অক্ষম করে দেয়ার জন্য। এভাবেই চীনের শাসনকর্তারা উইঘুর জাতিসত্তাকে দেশ থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করছে।
পূর্বোক্ত নিবন্ধের লেখক রায়হান আসাতের ভাই একপার আসাতও এই নির্যাতনের শিকার। জাতিগত সংখ্যালঘু ও শিনজিয়াংয়ের স্থানীয় সরকারের মধ্যে এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে ভূমিকা ছিল একপারের। এজন্য সরকারের কাছে বেশ প্রশংসিতও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরে তাকে অন্য উইঘুরদের পরিণতিই বরণ করতে হয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি একপার আসাত।
জানা যায়, জাতিগত বিদ্বেষ উসকে দেয়ার অভিযোগে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে তাকে। অথচ তার বিরুদ্ধে করা মামলার কোনো নথি আদালতে পাওয়া যায়নি।
২০১৭ সালে বিশেষ স্থানীয় নির্দেশাবলি নিয়ে শিনজিয়াংয়ে ‘স্পেশাল ক্যাম্পেইন টু বার্থ কন্ট্রোল ভায়োলেশন’ নামের অভিযান চালানো হয়। সরকার ২০১৯ সালের মধ্যে শিনজিয়াংয়ের দক্ষিণাঞ্চলে সন্তান জন্মদানে সক্ষম ৮০ শতাংশের বেশি নারীকে জোরপূর্বক বন্ধ্যত্ব করে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এজন্য নারীদের জরায়ুতে ইনট্রাইউটেরিন ডিভাইস (আইইউডি) স্থাপন বা স্টেরিলাইজেশন সার্জারি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আইইউডি সাধারণত ৫ থেকে ১০ বছর নারীদের গর্ভধারণ করা থেকে বিরত রাখে। এ অভিযানের লক্ষ্য- উইঘুরদের জন্মহার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা।
সরকারি নথির তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ ও ২০২০ সালে গণহারে নারীদের বন্ধ্যত্বকরণের খরচ দেয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে। বর্তমান নারী বন্ধ্যত্বকরণের হার ইতোমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে অতীতের এক সন্তান নীতির আওতায় করা বন্ধ্যত্বকরণের হারকে। জন্মদানে সক্ষম নারী অনুসন্ধানে শিনজিয়াং সরকার শরণাপন্ন হয়েছিল ‘ড্যাগনেট স্টাইল’ নামক তদন্তের। এ ধরনের তদন্তে আনুষ্ঠানিকভাবে ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। একবার সরকারের দুষ্টচক্রের কবলে পড়লে নারীদের স্টেরিলাইশন সার্জারি এড়ানোর আর কোনো উপায় থাকে না। বাধা দিলে বরণ করতে হয় বন্দির জীবন। একবার আটক হলে অভিযুক্তকে গর্ভপাত করতে ও অজানা সব ওষুধ গ্রহণে বাধ্য করা হয়।
পরিসংখ্যান বলছে, এসব পদক্ষেপ নিয়ে উইঘুর জনসংখ্যা কমাতে সফল হয়েছে চীন সরকার। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে শিংজিয়াংয়ে উইঘুর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে ৮৪ শতাংশ। অন্যদিকে সরকারি নথিতে দেখা গেছে, স্টেরিলাইজশন সার্জারির হার চীনব্যাপী কমলেও শিনজিয়াংয়ে বেড়েই যাচ্ছে। আর এসব কর্মসূচিতে ব্যয়ের জন্য তহবিলও বাড়ছে। ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে একটি জেলায় বন্ধ্যত্ব ও বিধবা নারীর হার বেড়েছে যথাক্রমে ১২৪ ও ১১৭ শতাংশ। ২০১৮ সালে চীনে আইইউডি স্থাপনের ৮০ শতাংশই হয়েছিল শিনজিয়াংয়ে। এসব আইইউডি কেবল রাষ্ট্র অনুমোদিত সার্জারির মাধ্যমেই অপসারণ করা যায়। অন্যথায় স্বীকার করে নিতে হয় বন্দিশালা।
গত বছর চীনের কাশগড়ে জন্মদানে সক্ষম মাত্র তিন শতাংশ নারী সন্তানের জন্ম দিতে পেরেছিলেন। এসব অঞ্চলে নির্যাতনের তথ্য গোপন করতে বার্ষিক প্রতিবেদনে জন্মহার সম্পর্র্কিত তথ্য আর দেয়া হচ্ছে না। উইঘুরদের ওপর নির্যাতনের তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সব তথ্য সরিয়ে দিয়েছে চীন।
উইঘুর পুরুষদের বন্দি ও নারীদের বন্ধ্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি চীন সরকার। এ গোষ্ঠীর শিশুদের জন্যও পদক্ষেপ নিয়েছে তারা। অন্তত পাঁচ লাখ শিশুকে তাদের পরিবারের কাছ থকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এই শিশুরা বেড়ে উঠছে রাষ্ট্রের কথিত ‘শিশু আশ্রয়কেন্দ্রে’। ধর্মীয়, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধের ঘেরাটোপে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন উইঘুররা।
নজরদারি সহজ করতে শিনজিয়াং একটি কঠোর ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে কাজ করে। এ ব্যবস্থায় শহর ও গ্রামগুলো খণ্ড খণ্ড অংশে ভাগ করা হয়। একেকটি খণ্ডে থাকেন ৫০০ মানুষ। এসব এলাকায় রয়েছে একটি করে থানা। থানার কর্মকর্তারা জনসাধারণের পরিচয়পত্র, মুখ, ডিএনএ নমুনা, আঙুলের ছাপ, সেলফোন স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। সবই পরিচালনা করা হয় ‘ইনটিগ্রেটেড জয়েন্ট অপারেশন্স প্ল্যাটফর্ম’ নামের যন্ত্রচালিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
এ পদ্ধতিতে মেশিন লার্নিং ব্যবহারের মাধ্যমে ভিডিও নজরদারি, স্মার্টফোনে থাকা তথ্য ও অন্যান্য ব্যক্তিগত রেকর্ড পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তাদের তালিকা তৈরি করা হয়। এরপর তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের গন্তব্য হয় বন্দিশিবির। উইঘুরদের ওপর নজর রাখতে তাদের পরিবারগুলোয় চীন সরকার বহাল করেছে ১০ লাখেরও বেশি চীনা হান জাতিসত্তার মানুষ। সরকারকে উইঘুরদের সব তথ্য দেয় তারা।
চীন সরকার দেশের অভ্যন্তরে নজরদারি পরিচালনা করে কঠোরভাবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাদের কর্মকাণ্ডে নাক গলাতে মানা করেছে একাধিকবার। অথচ উইঘুরদের ওপর নির্যাতন রোধে এ মুহূর্তেই ব্যবস্থা নেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তা না হলে, এ জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার পদক্ষেপ সফল হতে খুব বেশি সময় লাগবে না চীন সরকারের। আর এতে চীন সরকার সফল হলে, তা হবে গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয়া।
আরেকটি মানব বিপর্যয় এড়াতে উইঘুর হিউম্যান রাইটস পলিসি অ্যাক্ট পাসের সাথে আরো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। মার্কিন কংগ্রেসের ৭৮ জন সদস্য চীনের এ কাজে জড়িত কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন। উইঘুরদের প্রতি নির্যাতনের কঠোর সমালোচনা করে ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র মর্গান ওর্তেগাস বলেছেন, ‘হলোকাস্টের পর সবচেয়ে বর্র্বরোচিত অপরাধ এটি।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি গণহত্যা হলোকাস্ট নামে পরিচিত। গণহত্যার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা কেবল প্রতীকি কোনো বিষয় নয়। শিনজিয়াংয়ের গণহত্যা ঠেকাতে গোটা বিশ্বকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন আমেরিকান-টার্কিশ ইন্টারন্যাশনাল ল’ইয়ারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আইনজীবী রায়হান আসাত ও রাউল ওয়ালেনবার্গ সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটসের লিগ্যাল কাউন্সেল ইয়োনা ডায়মন্ড।
তারা বলছেন, ‘গণহত্যা ঠেকাতে সবাই জোটবদ্ধ হলে তেমনটা করা কঠিন হবে না। কারণ এই আন্তঃসংযোগের পৃথিবীতে গণহত্যা বিষয়টি শনাক্ত করতে ব্যর্থ হলে আমরা কেবল নীরব দর্শকের ভূমিকাই পালন করব না, হবো এই অবৈধ কাজের ইন্ধনদাতাও।’