জনতার প্রতিরোধে বাঁচল কোরিয়ার গণতন্ত্র

বাজেট ও আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল। উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে এবং উত্তর কোরিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীলদের শায়েস্তা করতে তিনি গত ৩ ডিসেম্বর সামরিক আইন জারি করেন। তবে প্রতিবাদী জনতা ও পার্লামেন্ট সদস্যদের কারণে এ যাত্রায় দক্ষিণ কোরিয়া গণতান্ত্রিক কাঠামো রক্ষা করতে সমর্থ হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দেয়।

৩ ডিসেম্বর রাতে হঠাৎ করেই টেলিভিশনে এক ভাষণে ইউন সামরিক আইন জারির ঘোষণা দেন। তবে ওই ভাষণে তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট হুমকি বা যুদ্ধের শঙ্কা প্রকাশ করেননি। সামরিক আইন ঘোষণার পরই দক্ষিণ কোরিয়ার পার্লামেন্টের এমপিরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। সামরিক আইন জারি হলে রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যেত, গণমাধ্যম ও প্রকাশনার কাজও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসত। এতে বিরোধী দল ও সরকারি দলের মধ্যে এক বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে পার্লামেন্টের আইন প্রণেতারা একযোগে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।

ইউন সুক ইওল সামরিক শাসন জারির ঘোষণা দেওয়ার পর সেনা সদস্যরা রাজপথে নেমে এসে রাজধানী সিউলের পার্লামেন্ট ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। সামরিক বাহিনী চেয়েছিল পার্লামেন্ট সদস্যরা যেন পার্লামেন্টে সমবেত হয়ে সামরিক আইন জারির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাসের সুযোগ না পান। পার্লামেন্টে বিরোধী পক্ষ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় সামরিক আইনের আওতায় ভিন্নমত দমনের জুতসই একটি উপায় হিসেবে এ পদক্ষেপ নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। তবে তা তার জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। সামরিক আইন জারির পর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দেশটির পার্লামেন্ট। তীব্র প্রতিবাদ জানান এমপি ও রাজনীতিবিদরা। 

রাজপথে নামে লাখো জনতা। রাতেই কয়েক লাখ মানুষ পার্লামেন্ট ভবন এলাকায় সমবেত হয়ে প্রেসিডেন্টের সামরিক আইন জারির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। এমপিরাও সামরিক বাহিনীর বাধা ডিঙিয়ে পার্লামেন্ট ভবনে প্রবেশ করে জরুরি অধিবেশনে মিলিত হয়ে প্রেসিডেন্টের সামরিক আইন জারির সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ফলে চাপের মুখে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সামরিক আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট। সমবেত জনতা সেনা সদস্যদের তৈরি প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে পার্লামেন্ট ভবনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। 

এই উত্তেজনাকর অবস্থায় প্রেসিডেন্ট ইউন কিছু সময় পরই তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেন এবং সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেন। এরপর গত ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইউন এমন পরিস্থিতির জন্য জনগণের কাছে গভীর দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছেন। পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে তিনি তার রাজনৈতিক দল পিপলস পাওয়ার পার্টির (পিপিপি) সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন বলে জানিয়েছেন। তবে এ ঘটনা দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতে গভীর উদ্বেগ এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।

বিরোধী দল এবং বিভিন্ন এমপিরা ইউনের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্টের ভাষণের পর পিপিপির শীর্ষ নেতা হান ডং হুন সাংবাদিকদের জানান, দল সামরিক আইন জারি করা নিয়ে কোনো ছাড় দেওয়ার পক্ষে নয়। প্রেসিডেন্ট তার পদে থাকা এবং দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা হারিয়েছেন। তাকে পদত্যাগ করতেই হবে। তার এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, প্রেসিডেন্ট ইউনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সংকটাপন্ন। তার পদত্যাগের বিষয়ে দলীয় নেতারা একমত।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সামরিক শাসন জারির পর দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে যে বিভাজন তৈরি হয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি অস্থির হয়ে উঠেছে। বিরোধীদলীয় নেতা ও এমপিরা বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ইউন পদত্যাগ না করলে তারা তাকে অভিশংসনে পদচ্যুত করবেন। গত ৭ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের জন্য ভোট হয়। তবে এর আগে ক্ষমতাসীন দল পিপিপির বেশির ভাগ এমপি পার্লামেন্ট ত্যাগ করেন। এতে সেখানে হট্টগোল শুরু হলে ভেস্তে যায় অভিশংসনের প্রচেষ্টা। আবারও ১৪ ডিসেম্বর অভিশংসন চেষ্টা চালাবে বলে জানিয়েছে দেশটির প্রধান বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টির (ডিপি) নেতা লি জে মুং। 

সংবিধান অনুযায়ী, ইউন পদত্যাগ করলে বা অভিশংসিত হলে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবেন প্রধানমন্ত্রী। ইউনের প্রেসিডেন্সির মেয়াদ ছিল ২০২৭ সালের মে মাস পর্যন্ত। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা ত্যাগ করলে সংবিধান অনুযায়ী এর ৬০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh