বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ ও বৈচিত্র্যময় দেশে অপরাধ হওয়াটা নতুন কিছু নয়। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ছোট-বড় নানা ধরনের অপরাধের ঘটনা ঘটে। কিন্তু যেকোনো অপরাধ ঘটলেই যদি মানুষ নিজে বিচার করতে শুরু করে, তাহলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। একটি অপরাধ ঘটলে তার তদন্ত, বিচার ও শাস্তির একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। এই প্রক্রিয়া পরিচালনা করে রাষ্ট্র।
বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি অপরাধে অভিযুক্ত হলে তার বিচার হবে আদালতে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, কোথাও কোনো বড় অপরাধের ঘটনা ঘটলেই স্থানীয় কিছু মানুষ উত্তেজিত হচ্ছে। তারা নিজেরাই বিচারকের ভূমিকা নিয়ে নিচ্ছে।
বিশেষ করে যখন কেউ ধর্ষণ, খুন বা নৃশংস কোনো অপরাধে অভিযুক্ত হয়, তখন জনতার একাংশ সেই আসামির বাড়িঘরে হামলা চালায়, ভাঙচুর করে বা আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা মনে করে, এটাই হলো অপরাধের উপযুক্ত প্রতিশোধ।
কিন্তু বাস্তবে এই প্রতিশোধপরায়ণ আচরণই একটি নতুন অপরাধ সৃষ্টি করে। আইন কখনোই কাউকে অনুমতি দেয় না, যে কেউ নিজে গিয়ে অপরাধীর বিচার করবে বা শাস্তি দেবে।
কোনো ব্যক্তি অপরাধে অভিযুক্ত মানেই তিনি অপরাধী এই ধারণা ভুল। আদালতে সঠিক প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষী বলা যায় না। আর যদি কেউ সত্যি অপরাধ করে থাকে, তবে তার বিচার হবে কেবল আইন অনুযায়ী, আদালতের মাধ্যমেই।
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪৩৫ ধারায় বলা আছে, যদি কেউ আগুন লাগিয়ে বা বিস্ফোরক ব্যবহার করে অন্য কারো বাড়িঘর, দোকান বা অন্য কোনো সম্পত্তি ধ্বংস করে, তাহলে তার সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
শুধু তাই নয়, দণ্ডবিধির ১৪৩ থেকে ১৪৯ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ বেআইনি জনসমাবেশ ঘটায়, দলবদ্ধভাবে হামলা চালায় বা কোনো ব্যক্তির সম্পত্তির ক্ষতি করে, তাহলে সেটিও একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।এসব অপরাধের জন্যও রয়েছে কঠিন শাস্তির বিধান। আমরা অনেক সময় আবেগে ভেসে যাই।
ভাবি, ‘সে এমন একটি অপরাধ করেছে, এখন তাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে।’ কিন্তু আইন কখনো আবেগ দিয়ে চলে না। বিচার হয় তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে।
আরেকটি বিষয় মনে রাখা জরুরি এভাবে বিচার না হলে নিরীহ কেউ হামলার শিকার হতে পারে। কোনো ভুল খবর বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গুজবের ভিত্তিতে যদি কারো বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে যে ক্ষতি হয়, তা অনেক সময় আর পূরণ করা যায় না।
এ ছাড়া এমন আচরণ সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। যখন সবাই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, তখন একের পর এক অপরাধের জন্ম এবং বিচারহীনতার
সংস্কৃতি তৈরি হয়। এতে আইন-শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার বিপন্ন হয়। তাই আমাদের সবারই উচিত, কোনো অপরাধ ঘটলে তা সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের কাছে জানানো। আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে, তদন্ত ও বিচারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালতের ওপর আস্থা রাখা।
স্মরণে রাখতে হবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে আইন মানতে হবে সবাইকে। আসামি মানেই অপরাধী নয়। বিচার হবে আদালতে, নিয়মতান্ত্রিকভাবে। আর কেউ যদি সত্যিই অপরাধ করে থাকে, তবে তার শাস্তি হোক আইনের চোখে, আগুনে পুড়িয়ে নয়।