
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বাতিল হওয়া নিবন্ধন ফিরিয়ে দিতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে আপিল বিভাগ।
তবে দলটির প্রতীক হিসেবে ‘দাঁড়িপাল্লা’র বিষয়ে কোনো আদেশ দেননি আদালত। এই বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
রবিবার সকালে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদসহ ৪ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় দেন।
রায়ের পর জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, “দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময়ের আইনী লড়াইয়ের সফল অবসান হলো। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আজ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে নিবন্ধন ফিরে পেল।
“আজকের রায়ের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক এবং অংশগ্রহণমূলক সংসদ প্রাপ্তি নিশ্চিত হলো। আমরা আশা করি এই রায়ের পর বাংলাদেশে সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাণবন্ত সংসদ গঠিত হবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে শিশির মনির বলেন, “আজকে যে ডাইরেকশন আপিল বিভাগ দিয়েছে, সেই ডাইরেকশনের আদালত বলেছেন জামায়াতের রেজিস্ট্রেশন এবং অন্য কোনো ইস্যু যদি ইলেকশন কমিশনের সামনে থাকে তাহলে যেন ইলেকশন কমিশন এটা ডিসপোস করে।
“অন্য ইস্যু বলতে আমরা বোঝাচ্ছি প্রতীক সংক্রান্ত ইস্যু। আমরা আশা করি ইলেকশন কমিশন নিবন্ধনের বিষয়টিও নিষ্পত্তি করবেন। একইসঙ্গে অন্য ইস্যু হিসেবে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের ব্যাপারটিও নিষ্পত্তি করবেন।”
রায়ের পর ইসির আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দিয়েছিল। ২০১৩ সালে এক রিট মামলার প্রেক্ষিতে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে রায় দেয় হাইকোর্ট। এরপর হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে।
“আজ হাইকোর্টের জাজমেন্ট স্যাটেসাইট (বাতিল) করে দিয়েছে আপিল বিভাগ। এর ফলে হাইকোর্টের রায় আর থাকছে না। অর্থাৎ ২০১৩ সালের আগে জামায়াতে নিবন্ধন যে অবস্থায় ছিল এখন সেই অবস্থায় ফিরে গেল।”
ইসির আইনজীবী বলেন, “২০১৩ সাল পর্যন্ত জামায়াতের নিবন্ধন বহাল ছিল। ওই সময়ে জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র নির্বাচন কমিশন পর্যালোচনা করছিল। এখন জামায়াতের নিবন্ধন বিষয়ে ওই পর্যায় থেকে শুরু করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্দেশ দিয়েছে আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগের আদেশ হাতে পাওয়ার পর এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।”
গত ১৪ মে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বাতিল হওয়া নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পেতে আপিলের শুনানি শেষ হয়। সেদিন এ বিষয়ে রায় ঘোষণার জন্য ১ জুন দিন ধার্য করা হয়।
সেদিন জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে আদালতে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী ও মোহাম্মদ শিশির মনির। সঙ্গে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইমরান আবদুল্লাহ সিদ্দিক ও নাজিব মোমেন। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম।
১২ মার্চ রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বাতিল হওয়া নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার প্রশ্নে আপিল শুনানি শুরু হয়।
২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল মামলাটি (আইনজীবী হাজির না থাকায়) খারিজ করে দেয়। এরপর আপিলটি পুনরুজ্জীবনের জন্য আবেদন করা হয়। গত বছরের ২২ অক্টোবর আদালত বিলম্ব মার্জনা করে আপিলটি শুনানির জন্য পুনরুজ্জীবিত (রিস্টোর) করে।
ওইদিন আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এহসান আব্দুল্লাহ সিদ্দিক ও শিশির মনির। এরপর ৩ ডিসেম্বর আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়েছিল।
২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িক নিবন্ধন দেওয়া হয়। পরের বছর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন।
রিটে জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নির্বাচন কমিশনসহ চারজনকে বিবাদী করা হয়। তারা জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের আর্জি জানান।
রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. আবদুল হাইয়ের (বর্তমানে অবসর) হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রুল জারি করেন।
জামায়াতের নিবন্ধন প্রশ্নে রুল জারির পর ওই বছরের ডিসেম্বরে একবার, ২০১০ সালের জুলাই ও নভেম্বরে দুইবার এবং ২০১২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে দুইবার তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়। এসব সংশোধনীতে দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করা হয়।
২০১৩ সালের ১২ জুন ওই রুলের শুনানি শেষ হয়। একই বছরের ১ আগস্ট জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন (বর্তমানে অবসর), বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (পরে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের (১৯ নভেম্বর পদত্যাগ করেন) সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ।
সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত বলে, এ নিবন্ধন দেওয়া আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত। একইসঙ্গে আদালত জামায়াতে ইসলামীকে আপিল করারও অনুমোদন দিয়ে দেন। তবে এ রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। পরে একই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে।
২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের আপিল খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ফের আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর গত বছরের ১ আগস্ট সরকার অঙ্গসংগঠনসহ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধের আবেদন বাতিলের উদ্যোগ নেয়। ২৮ আগস্ট সরকার নিষিদ্ধের আদেশ বাতিল করে।
এরপর
আপিল বিভাগে নিবন্ধন মামলাটি পুনরায় শুনানির জন্য আবেদন করে। ২২ অক্টোবর বিলম্ব মার্জনা
করে আপিলটি শুনানির জন্য পুনরুজ্জীবিত (রিস্টোর) করে সর্বোচ্চ আদালত। এর মধ্যে দিয়ে
নিবন্ধন ফিরে পেতে আইনি লড়াইয়ের পথ উন্মুক্ত হয় জামায়াতের।