শেখ হাসিনাই ‘নির্দেশদাতা’: ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ১৪:৫৭

শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রাণহানির ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দিয়েছে প্রসিকিউশন শাখা। অভিযোগে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেত্রীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের ‘নির্দেশদাতা’ চিহ্নিত করা হয়েছে।
রবিবার বেলা ১২টার দিকে এই অভিযোগ জমা দেওয়া হয়। প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
গত ১২ মে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখায় জমা পড়ে। এতে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পাশাপাশি আন্দোলনের সময়কার পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকেও আসামি করা হয়।
প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সেদিন আশা করেন, দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া সম্ভব হবে।
প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়, যার মধ্যে দুটি সেদিন প্রকাশ করেন তাজুল।
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে, তার জন্য প্রতিবেদনে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রীকেই দায়ী করা হয়। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “শেখ হাসিনার নির্দেশেই আন্দোলনে গুলি করে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটেছে, লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে—তদন্তে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।”
আন্তর্জাতিক আদালতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমার আনুষ্ঠানিকতা বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
কী অভিযোগ
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়, তার একটি ছিল ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে চীন সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্য।
তাজুল বলেন, “সেদিন শেখ হাসিনা আন্দোলনরত ছাত্রদের রাজাকারের সন্তান ও দৌহিত্র বলেছিলেন। এতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা ও বাহিনী আইনবহির্ভূত দমন-পীড়নে উদ্বুদ্ধ হয়।”
তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এরপর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ দলীয় অস্ত্র নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে এক হয়ে অভিযান চালায়।
প্রধান প্রসিকিউটর বলেন, “তারা হত্যা, গুলি করে আহত করা, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করে।”
এই অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে উসকানি, প্ররোচনা, সহায়তা, ষড়যন্ত্র এবং অপরাধ প্রতিরোধে ব্যর্থতার কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা দ্বিতীয় অভিযোগটি তার সরাসরি নির্দেশনা সংক্রান্ত।
তাজুল বলেন, “অনেকগুলো ফোনালাপ তদন্ত সংস্থা উদ্ধার করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা হেলিকপ্টার, ড্রোন, এপিসিসহ সব অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন।”
“সেই নির্দেশের সরাসরি প্রমাণপত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা হাতে পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগটি দাখিল করেছে”, বলেন তিনি।
তাজুল আরও বলেন, “শেখ হাসিনা শুধু হত্যা নয়, আহত করারও নির্দেশ দিয়েছেন। সহায়তা করেছেন, ষড়যন্ত্র করেছেন।”
বাকি তিন অভিযোগের বিষয়ে পরে জানানোর কথা জানিয়ে তাজুল বলেন, “সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন ঘটনায় শেখ হাসিনার নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে। কীভাবে মানুষকে মারা হয়েছে, কীভাবে বাকি নৃশংসতাগুলো করা হয়েছে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ঘটনাকেন্দ্রিক তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে- যেগুলোর বিস্তারিত আজকে প্রকাশ করছি না।”
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল শনিবার রাতে এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা হবে।
২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর উচ্চ আদালতের অনুমোদনে ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে—তাদের পাঁচজন জামায়াতের শীর্ষ নেতা, একজন বিএনপির।
তবে আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার পরও জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম খালাস পেয়েছেন। ২০২৪ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আপিল বিভাগে নতুন করে শুনানি হয়েছে মামলাটির এবং গত ২৭ মে তাকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
এই রায়ের পর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল লেখেন, “এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির কৃতিত্ব জুলাই গণআন্দোলনের অকুতোভয় নেতৃত্বের। এই সুযোগকে রক্ষা করার দায়িত্ব এখন আমাদের সবার।”
আওয়ামী
লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের আইনজীবী ছিলেন বর্তমানের চিফ
প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তাকেই রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী
করে অন্তর্বর্তী সরকার।