Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

বিবিয়ানায় সংকট

Icon

সিফাতুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:৪০

বিবিয়ানায় সংকট

বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড। ছবি: সংগৃহীত

গ্যাসের সংকট শিগগিরই দূর হচ্ছে না, আসছে গরমে সংকট আরও বাড়তে পারে। শঙ্কা তৈরি হয়েছে সবচেয়ে বড় রিজার্ভ বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড নিয়ে। দেশে উৎপাদিত গ্যাসের অর্ধেকের বেশি উৎপাদন আসছে বিবিয়ানা থেকে।

প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে উৎপাদন, হঠাৎ করেই বড় ধরনের ছন্দপতনের শঙ্কা করা হচ্ছে। তেমন পরিস্থিতি হলে সামাল দেওয়ার মতো বিকল্প নেই জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের হাতে।

মজুদ বিবেচনায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় গ্যাস ফিল্ড ধরা হয় বিবিয়ানাকে। পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, ১৯৯৮ সালে আবিষ্কৃত গ্যাস ফিল্ডটিতে প্রমাণিত, সম্ভাব্য ও সম্ভাবনাময় মিলে ৭০৮৪ বিসিএফ (৭.০৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস মজুদ ধারণা করা হয়। বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনের মালিকানাধীন ওই ফিল্ডের প্রমাণিত মজুদ ৪৪৪৫ বিসিএফ (বিলিয়ন ঘনফুট) আর সম্ভাব্য মজুদ বিবেচনা করা হয় ৫৭৫৫ বিসিএফ।

ফিল্ডটি থেকে গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন হয়েছে ৪৯৯১.৬০ বিসিএফ। অবশিষ্ট গ্যাস মজুদ রয়েছে ৭৬৩.৮৩ বিসিএফ। পেট্রোবাংলার ওই হিসেবের পর ইতোমধ্যে ৩৭৫ দিন অতিবাহিত হয়েছে। এতে দৈনিক কমবেশি ১.২০ হারে সর্বোমোট প্রায় ৪৫০ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। সে হিসেবে অবশিষ্ট গ্যাসের মজুদ রয়েছে মাত্র ৩১৩.৮৩ বিসিএফ। দৈনিক ১.১৫ বিসিএফ (৯ জানুয়ারি ২৩) গ্যাস উত্তোলন অব্যাহত থাকলে প্রকৃত অর্থে ২৭২ দিনের মজুদ অবশিষ্ট রয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ খোন্দকার আব্দুস সালেক সুফী বলেছেন, গ্যাস ফিল্ডটিতে উৎপাদন কমে আসবে এটা সবার জানা। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে যে কোনো সময় বড় ধরনের ধস নামতে পারে। শেষ দিকে গ্যাসের চাপ কমে যায়, তখন হঠাৎ করেই বড় ধরনের পতন হয়ে থাকে। অনেক দিন ধরেই কম্প্রেসর লাগিয়ে বাড়তি উৎপাদন করা হচ্ছে। জ্বালানি বিভাগ এখনই বিকল্প ভেবে না রাখলে বড় বিপদ ঘটতে পারে।

২০২০ সাল থেকেই গ্যাসের উৎপাদন কমতে শুরু করেছে। ওই বছরের ১৫ নভেম্বর গ্যাস উত্তোলন করা হয় ১৩৩৪.৯ মিলিয়ন ঘনফুট। পরের বছর ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর উৎপাদন নেমে আসে ১২৪৬.৮ মিলিয়নে। আর গত মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) উৎপাদন হয়েছে ১১৪৯ মিলিয়ন ঘনফুট। পেট্রোবাংলার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত বছর জুনের ১ তারিখে ১২৫৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়। পরের মাসে (জুলাই) ২০ মিলিয়ন কমে ১২৩৭ মিলিয়ন উত্তোলিত হয়। আগস্টে আরও ৬ মিলিয়ন কমে ১২৩১ মিলিয়নে দাঁড়ায়। সেপ্টেম্বরে আরও ৬ মিলিয়ন কমে ১২২৫ মিলিয়নে এ নেমে আসে।

বিবিয়ানার পাশাপাশি সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের উৎপাদনও নিম্নমুখী। গত জুনের ১ তারিখে ৯৬.৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়। জুলাইয়ে ৯২.৪ মিলিয়ন, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ৯১, অক্টোবরে ৯০ এবং নভেম্বরে ৮৯ মিলিয়নে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির উৎপাদনও নিম্নগামী।

কোম্পানিটির অধীনে থাকা  (তিতাস, হবিগঞ্জ, নরসিংদী, বাখরাবাদ ও মেঘনা) ৫টি গ্যাস ফিল্ডে গত এপ্রিলে উত্তোলন করা হয় ৬৩৯ মিলিয়ন গ্যাস, নভেম্বরের ১৫ তারিখে ৬১৪ মিলিয়ন, আর ৯ জানুয়ারি উৎপাদন নেমে এসেছে ৬০৪ মিলিয়নে।

যদিও বিবিয়ানায় মজুদের তুলনায় অনেক বেশি মজুদ রয়েছে ওই দুটি কোম্পানির গ্যাস ক্ষেত্রে। ১.২২ টিসিএফ মজুদ থেকে আমেরিকান কোম্পানি শেভরন দৈনিক উৎপাদন করছে ১১২৮ এমএমসিএফ। প্রায় দ্বিগুণ মজুদ (২.০২৬ টিসিএফ) থাকার পরও কৈলাশটিলা গ্যাস ফিল্ডে মাত্র ৩৩.৭ এমএমসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে।

বিবিয়ানার তুলনায় গ্যাসের রিজার্ভ অনেক বেশি তিতাস ও রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডেও। সেখানেও আশানুরূপ উৎপাদন করা হচ্ছে না। ১৯৬০ সালে আবিষ্কার হওয়া রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডের অবশিষ্ট মজুদ (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মিলে) রয়েছে (৩১ ডিসেম্বর ২০২০ হিসেব অনুযায়ী) ১.৭৭৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। রশিদপুরে গত ১৫ নভেম্বর গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে মাত্র ৪৩.৭ মিলিয়ন ঘনফুট। অন্যদিকে ভোলা আইল্যান্ডে অনেক উদ্বৃত্ত গ্যাস থাকলেও পাইপ লাইনের অভাবে মূল ভূখণ্ডে আনা যাচ্ছে না।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, উৎপাদনে বড় ধরনের ধস নামলে সামাল দেওয়ার মতো বিকল্প নেই। ঘাটতি মেটাতে আমদানি বাড়ানো হবে সেই সুযোগও নেই। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দৈনিক ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানির জন্য দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করা হয়েছে। নতুন করে আরও দুটি ভাসমান টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যা এখনো যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যে আটকে রয়েছে।

কার্যাদেশ দেওয়ার পর কমপক্ষে ১৮ মাস সময় লাগবে। এছাড়া একটি ল্যান্ড বেজড এলএনজি টার্মিনালের উদ্যোগ রয়েছে, সেই প্রক্রিয়া কাগজে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ ২০২৩ ও ২০২৪ সালে বাড়তি গ্যাস আমদানি সুযোগ একেবারেই ক্ষীণ। তত দিন বিবিয়ানা থেকে পাওয়া ১২০০ মিলিয়ন গ্যাস নিরবচ্ছিন্ন পাওয়া নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে।

পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, বিবিয়ানার রিজার্ভ কমে আসছে, সেটি সামাল দেওয়ার জন্য সেখানে নতুন এলাকায় কূপ খননের কাজ শুরু হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে সেখানে ভালো পরিমাণে গ্যাস পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খনন ও ওয়ার্কওভার চলমান রয়েছে। এতে ৬১৮ মিলিয়ন গ্যাস উৎপাদন বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বিবিয়ানার রিজার্ভের বিষয়টি মাথায় রেখেই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শঙ্কার কিছু নেই, আমরা অনেক কাজ হাতে নিয়েছি, এতে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি আমদানির সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজও এগিয়ে নিচ্ছি। কাতার আরও বেশি পরিমাণে গ্যাস দিতে সম্মত হয়েছে, ওমানের সঙ্গে আলোচনাও ইতিবাচক ধাপে রয়েছে।

২০২৫ সাল নাগাদ আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম কমে আসবে। দেশীয় গ্যাস ফিল্ডে যেটুকু কমে যাবে আমদানি করে সামাল দেওয়া হবে। গ্যাস সরবরাহে শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ২০২৫ সালে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দিতে আমরা বদ্ধপরিকর।

বাংলাদেশে মোট ২৮টি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। ২০টি গ্যাস ফিল্ডের ১০৪টি ক‚প দিয়ে দৈনিক (৯ জানুয়ারি) ২২৪৭ মিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এক সময় ২৮০০ মিলিয়ন পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫টি গ্যাস ফিল্ড (রূপগঞ্জ, কামতা, ফেনী, ছাতক ও সাঙ্গু) পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ৩টি গ্যাস ফিল্ড (কতুবদিয়া, ভোলা ও জকিগঞ্জ) বন্ধ রয়েছে গ্যাস সঞ্চালন ব্যবস্থা না থাকায়।

অন্যদিকে চাহিদার বিষয়ে স্পষ্ট করে কোনো তথ্য জানা না গেলেও পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ৯ জানুয়ারি ২১১৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চাহিদা ছিল শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনেই। ওই দিন বিদ্যুতে সরবরাহ করা হয় মাত্র ৮১৬ মিলিয়ন। এর বাইরে রয়েছে শিল্প, বাণিজ্যিক, ক্যাপটিভ, যানবাহন ও আবাসিক খাত। সেখানেও রয়েছে চরম সংকট। সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে বলা না হলেও অনেকেই মনে করে গ্যাসের প্রকৃত চাহিদা প্রায় ৫ হাজার মিলিয়নের মতো হবে।

বাংলাদেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান এখনো তিমিরেই রয়ে গেছে মনে করে সংশ্লিষ্টরা। ১০টি ক‚প খনন করে ১টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিবেচনা করা হয়। সেখানে বাংলাদেশে তিনটি কূপ খনন করে ১টি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ সীমানায় প্রথম কূপ খনন করা হয় ১৯১০ সালে।

বর্তমান সময় পর্যন্ত (১১০ বছরে) ৯৫টি কূপ খননের মাধ্যমে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে ৪২টি কূপের মধ্যে বর্তমান সরকারের ১৩ বছরে ২১টি কূপ খনন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অনুসন্ধান কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা হলে আজকে এই অবস্থার মুখোমুখি পড়তে হতো না।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫