
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর লোগো। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সরকারের বিভিন্ন নীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে নানা জরিপ কার্যক্রম চালিয়ে থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি। তাদের জরিপ-শুমারির তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই নেওয়া হয় দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো। কিন্তু গোড়ায় গলদ! এসব কাজে নৈতিকতা দেখভালের দায়িত্ব যাদের, সেই আইএমইডি নীতি-আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে আজ হন্যে শুধু টাকা লুটপাটে। কাজের নামে চলছে দুর্নীতি-গাফিলতি।
নানা অব্যবস্থাপনার কারণে অনেক জরিপের ফলাফলই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকাশ করা হয় না। আর সেই দীর্ঘসূত্রতার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সরকারের নীতি গঠনে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, যেসব লক্ষ্যে হাজার কোটি টাকা দিয়ে এ ধরনের জরিপ প্রকল্প নেওয়া হয়, প্রতিবেদন প্রকাশে বিলম্বের কারণে এর কোনোটিই অর্জন হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জরিপ পরিচালনা করা হয় বিভিন্ন বিষয়ের বাস্তব চিত্র উপস্থাপন ও ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি নির্ধারণের জন্য। নীতি প্রণয়নেও এর গুরুত্ব অনেক। তবে প্রতিবেদন প্রকাশের কয়েক বছর পূর্বের জরিপের ওপর ভিত্তি করে নীতি গ্রহণ করা হলে স্বাভাবিকভাবে তা সঠিক পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে না।
যদিও বিবিএসের অনেক প্রতিবেদন ২ থেকে ৪ বছর আগের জরিপের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি প্রকল্পের জরিপের ফলের সঙ্গে বর্তমান সময়ের ব্যাপক অসামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করা যায়। এর একটি কৃষি শুমারি ২০১৯ এবং আরেকটি ন্যাশনাল হাউজহোল্ড ডাটাবেজ (এনএইচডি)।
প্রকল্প দুটিতে ব্যয়ও হয়েছে হাজার কোটি টাকার বেশি। দীর্ঘসূত্রতার কারণে জরিপের প্রাপ্ত তথ্যের ওপর নির্ভর করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে তথ্যের অসামঞ্জস্যতার সম্মুখীন হতে হয় নীতিনির্ধারকদের। তাদের দাবি, দীর্ঘসূত্রতার ফলে নীতি প্রণয়নে কাজে আসছে না শত শত কোটি টাকা ব্যয়ের এসব প্রকল্প।
সংস্থাটির কয়েকটি জরিপ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের কয়েকটি জরিপের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে ২০২১ কিংবা ২০২২ সালে। আবার এখনো প্রকাশ পায়নি এমনটিও হয়েছে। দেখা যাচ্ছে জরিপের তথ্য সংগ্রহের সময় ও প্রকাশের ব্যবধান ২ থেকে ৪ বছর। প্রকল্পভেদে আরও অধিক সময়ের তফাতও লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে কৃষি (শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ) শুমারি ২০১৯-এর প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। যদিও কৃষি শুমারির এ প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১৮ সালে। জরিপ ও প্রতিবেদন প্রকাশের ব্যবধান প্রায় ৩ বছর।
নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে পুরাতন এ তথ্যগুলো সহায়ক হবে কিনা জানতে চাইলে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এসআইডি) সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহীম বলেন, ‘বাসি খাবার যেমন মানুষ খেতে পারে না তেমনই পরিসংখ্যান বাসি হয়ে গেলে দাম থাকে না। পুরাতন তথ্য দিয়ে নীতি গ্রহণ করলে এটা কোনো কাজে দেবে না।
পরিসংখ্যান যত দ্রুত সম্ভব জানিয়ে দেওয়া উচিত। তথ্য সংগ্রহে সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে দেরি হওয়ার কারণ আছে বলে আমার জানা নেই। এর প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত। শুনেছি কৃষি শুমারির তথ্য মিলছে না। তাই ছোট ছোট জরিপ করে এর সমাধান করা যেতে পারে।’
কৃষি শুমারিতে ব্যয় হয়েছে ৩৬১ কোটি ৬৯ লাখ ৬ হাজার টাকা। এমন দীর্ঘসূত্রতার কারণে নীতি প্রণয়নে প্রকল্পটি খুব একটা কাজে আসছে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, সাধারণত এমন প্রকল্পগুলো নেওয়া হয় সে সময়ের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাহায়ক ভূমিকা রাখার জন্য। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ২০১৯ সালের জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় ২০২২ সালের শেষে। এটা স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় তিন বছর আগের এ ফলাফল বিশ্লেষণ করে কোনো নতুন নীতি গ্রহণ বা বড় প্রকল্প নেওয়া কঠিন।
নীতি প্রণয়নে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শত কোটি টাকা ব্যয়ের এ জরিপ কতটুকু কাজে দিচ্ছে তা বিশ্লেষণ করার বিষয়। বিলম্বিত কৃষি শুমারি প্রতিবেদন ২০১৯ প্রকাশকালে খোদ পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমও আক্ষেপ করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কয়েক বছর আগের একটা জরিপের ফল স্বাভাবিকভাবে বর্তমান সময়ের সঙ্গে মিলবে না। বোঝাই যাচ্ছে এ রিপোর্ট আমাদের নীতি প্রণয়নে খুব একটা সাহায্য করবে না।
এ জরিপ অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু যথাসময়ে প্রকাশ না হলে এর ফলাফল কাগজেই থেকে যাবে। বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। সারা বিশ্বে বিবিএসের তথ্য গুরুত্বপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরা হয়। তাই আমাদের সময়ের বিষয়ে সচেতন হতে হবে।’
এদিকে করোনা মহামারির শুরুতে ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু দরিদ্রের সঠিক তালিকা না থাকায় ১৫ লাখ পরিবারের কাছে এ অর্থ সহায়তা পৌঁছানো যায়নি। যদিও অতিদরিদ্রের নির্ভুল তালিকা তৈরিতে ২০১৩ সালেই নেওয়া হয়েছিল ন্যাশনাল হাউজহোল্ড ডাটাবেজ (এনএইচডি) নামে একটি প্রকল্প।
আর এর চিত্র কৃষি শুমারির চেয়ে আরও ভয়াবহ। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের এসএমওডিআরপিএ প্রকল্প ও বিবিএসের আওতায় দেশের অতিদরিদ্র মানুষের তালিকা তৈরি করতে এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। ২০১৩ সালে নেওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ালেও চার বছরের কাজ ১০ বছরেও শেষ হয়নি।
২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবরের মধ্যে তিন ধাপে সারা দেশের দরিদ্রের তথ্য সংগ্রহ করতে জরিপ পরিচালনা করা হলেও এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন এখনো তৈরি করতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত চার বছর মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩২৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়ায় সেই ব্যয় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৭২৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকায়।
বিবিএসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, দ্বিগুণ ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধির পরও এখনো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমানে প্রকল্পের কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে এলেও কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে দারিদ্র্যের হারে অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। ফলে সোয়া ৭০০ কোটি টাকার এ জরিপের তথ্যও কোনো কাজে আসবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়।
প্রকল্পের বিলম্বের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. মাতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমি এতটুকু জেনেছি যে, এনএইচডি প্রকল্পের কাজ গত ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। এখন কী অবস্থা বলতে পারব না। আমি নতুন এসেছি, যারা এ প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তারা বিস্তারিত বলতে পারবেন।’
প্রকল্প পরিচালক কাজী তোফায়েল হোসেন বলেন, ‘এ প্রকল্পের জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে। আমাদের মূল কাজ শেষ হয়েছে। আনুষ্ঠানিক কিছু কাজ বাকি আছে। তবে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার জন্য এটা অন্যান্য প্রতিবেদনের মতো প্রকাশ করা হবে না।’
পরিসংখ্যান ব্যুরোর আরও বিভিন্ন জরিপ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এমন আরও অনেক প্রকল্প রয়েছে যেগুলোর জরিপের তথ্য সংগ্রহের কয়েক বছর পর প্রকাশ করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টদের অব্যবস্থাপনাকেই প্রতিবেদন প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতার কারণ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক নিতাই চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘জরিপ প্রতিবছরই হওয়া উচিত।
কিন্তু অধিক অর্থ ব্যয়ের কারণে আমাদের দেশে সেটি করা সম্ভব হয় না। জরিপ হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন হওয়া জরুরি। বিশেষ কোনো কারণ থাকলে সর্বোচ্চ এক বছর হতে পারে। নতুবা এ জরিপ এবং বিপুল অর্থব্যয় কোনো কাজে দেবে না। জনশুমারি ঠিক সময়ে হতে পারলে অন্যগুলো হওয়া কঠিন কিছু নয়।’