
কমে যাচ্ছে বিদেশিদের প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড়। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব পরিস্থিতিতে সরকার অর্থের জোগান নিয়ে বেকায়দার রয়েছে। দেশের অর্থনীতির সব হিসাব-নিকাশকে এলোমেলো করে দিয়েছে কোভিড-১৯। এর ধাক্কা শেষ না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যখন সংকট, অর্থের প্রয়োজন, ঠিক তখনই বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড়ে পতন ধরেছে। বছর ব্যবধানে গত ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বিদেশিদের ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি ৬০ শতাংশ কমেছে। আর ১০ শতাংশ অর্থ কম ছাড় করেছে উন্নয়ন সহযোগীরা।
ঋণ সহায়তাকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুতি যেমন কমেছে, ঠিক আগের দেয়া প্রতিশ্রুতির অর্থও ছাড়ে বেশ অনীহা। অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ এই মুহূর্তে আমাদের কম সুদে বিদেশি ঋণ সহায়তা নেয়া প্রয়োজন। কারণ আমাদের রিজার্ভ চাপের মধ্যে আছে। এই চাপ সামলাতে পাইপলাইনে যেসব ঋণ আছে, সেগুলো দ্রুত ছাড় করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে প্রকল্প ও বাজেট সহায়তায় প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। অর্থবছরের শুরুতে মোট বৈদেশিক ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ৩৮২ বিলিয়ন ডলার।
পরবর্তীকালে আইএমএফ সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হওয়ায় সেখান থেকে ৪৪৮ মিলিয়ন ডলার চলতি অর্থবছরে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে মোট ঋণ পাওয়া যাবে ১২ হাজার ৮৩০ মিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১০৬ টাকা ধরে)।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৪৪০ কোটি (৪.৪০ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দাতারা। আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে একই সময়ে সেটা ১৭৬ কোটি ২২ লাখ (১.৭৬ বিলিয়ন) ডলারে নেমে এসেছে। হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে বিদেশি ঋণ-সহায়তার প্রতিশ্রুতি কমেছে ৬০ শতাংশ।
অথচ চলতি অর্থবছরের এডিপিতে ৩৩০টি প্রকল্পের বিপরীতে বৈদেশিক ঋণ থেকে ৯৩ হাজার কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা হয়েছে। আর বাকি ৪৭ হাজার কোটি টাকা বাজেট সহায়তায় খরচ করা হবে। সবচেয়ে বেশি ২৩৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার বৈদেশিক ঋণ দেবার কথা বিশ্বব্যাংকের। যার মধ্যে গত ছয় মাসে তারা দিয়েছে ৫৪ কোটি ৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার। এরপর ১৭১ কোটি ২০ লাখ ডলার দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। যা আগের বছরের ছাড়ের চেয়ে কম। সংস্থাটি ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫৬ কোটি ৭৩ লাখ ৪০ হাজার ডলার ছাড় করেছে।
এরপর ২৮২ কোটি ৫০ লাখ ডলার দেবে জাইকা ও আমেরিকা। সেখানে পাওয়া গেছে ৯৮ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। ইউরোপ উইংয়ের দেশগুলো থেকে আসবে ২২৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সেখান থেকে ইতোমধ্যেই ৫৭ কোটি ২৯ লাখ ডলার পাওয়া গেছে।
২৯৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার দেবে এশিয়া জয়েন্ট ইকোনমিক কমিশন (জেইসি) ও ফেলোশিপ অ্যান্ড ফাউন্ডেশন (এফঅ্যান্ডএফ) উইং সংশ্লিষ্ট দেশ। তারা ইতোমধ্যে প্রায় একশ কোটি ডলার ছাড় করেছে। এছাড়া অন্যান্য দেশ ও সংস্থা থেকে আসবে ২৭ কোটি ডলার। এখান থেকে ছাড় হয়েছে দশ কোটি ডলারের বেশি।
প্রত্যাশার কথা হলো, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণ-সহায়তা পাওয়া গেছে। এই ছয় মাসে সবচেয়ে বেশি অর্থ ছাড় করেছে জাপান। ৯২ কোটি ১৬ লাখ ১০ হাজার ডলার। ছয় মাসে মোট বিদেশি ঋণের ২৪ দশমিক ৩৭ শতাংশই জাইকার।
ইআরডির হালনাগাদ তথ্য বলছে, অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও বৈদেশিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ ও অর্থ সহায়তা কম পাচ্ছে সরকার। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সরকার বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ ও সহায়তা বাবদ ৩৭৮ কোটি ৫ লাখ ডলার পেয়েছে। যা গত অর্থবছর একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৯ কোটি ডলার কম। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল প্রায় সোয়া চারশ কোটি ডলারের কিছু বেশি। ছাড় ও প্রতিশ্রুতি কমে গেলেও সরকারের পরিশোধের মাত্রা বাড়াতে হয়েছে।
চলতি জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে আগে নেয়া ঋণের আসল ও সুদ বাবদ ১০৫ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার পরিশোধ করেছে সরকার। গত বছরের একই সময়ে সুদ-আসল বাবদ প্রায় একই পরিমাণ ১০৪ কোটি ৪ লাখ ডলার শোধ করা হয়েছিল। সে হিসাবে এই ছয় মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধ বাবদ ১ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে সরকারকে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এদিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপে পড়েছে। অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর পাশাপাশি রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩২ বিলিয়ন ডলারে। এই চাপ সামলাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এখন কম সুদে বিদেশি ঋণ-সহায়তা। কিন্তু তেমনটি না হয়ে উল্টো কমছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। যা আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে ছয় মাস অন্তর অন্তর সাত কিস্তিতে পাওয়া যাবে। আইএমএফের সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে ৪৪৮ মিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে।
২০২১-২২ অর্থবছর শেষে পাইপলাইনে বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ ৪৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এর আগে সেই অর্থবছরের শুরুতে পাইপলাইনে ছিল ৫০ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার বলে ইআরডির তথ্য থেকে জানা গেছে।
ইআরডির প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতা-পরবর্তী থেকে গত ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট বিদেশি ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি ছিল ১৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ ছাড় দেয়া হয়েছে। প্রতিশ্রুতির পরও ছাড় হয়নি এমন বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৪৮ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে. মুজেরির মতে, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণে যেসব প্রকল্প এখন বাস্তবায়ন হচ্ছে এর মধ্যে অনেক প্রকল্পই বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কোভিডপরবর্তী সময়ে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজের গতি বেড়েছে।
এছাড়া সরকার বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নে বিদেশ থেকে বাজেট সহায়তা নিচ্ছে। তিনি বলেন, নমনীয় সুদে বাজেট সহায়তা ঋণ নেয়ার কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার চাপ কিছুটা হলেও কম ছিল।
তিনি বলেন, বৈদেশিক ঋণের অনেক মেগা প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাচ্ছে। আগামী কয়েক বছরে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে। ফলে এখন থেকে সরকারকে সতর্ক হতে হবে। আগামীতে বৈদেশিক ঋণের চাপ কমাতে রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
অর্থনীতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআই নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরের বিশ্লেষণ হলো, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক), এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) কাছ থেকে সরকার বাড়তি বাজেট সহায়তার প্রত্যাশা করছে। সে হিসেবে জোর প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এসব ঋণ যদি পাওয়া যায়, তাহলে এই অর্থবছর শেষে মোট ঋণ-সহায়তার পরিমাণ ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে না।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক কারণে পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে। আর এই চাপ সামলাতে এই মুহূর্তে কম সুদে বেশি বিদেশি ঋণের খুব দরকার ছিল। কিন্তু উল্টো কমে যাচ্ছে বিদেশিদের প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড়।