Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিইআরসির দ্বন্দ্বের নেপথ্যে!

Icon

সিফাতুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:০১

মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিইআরসির দ্বন্দ্বের নেপথ্যে!

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের লোগো। ছবি: সংগৃহীত

গ্যাস ও বিদ্যুতের বিতরণ কোম্পানিগুলোতে প্রফিট বোনাসের নামে বছরে কোটি কোটি টাকা ভাগ বাটোয়ারা হয়। সেই প্রফিট বোনাসের একটি বড় অংশ পৌঁছে যায় নিচ থেকে উপরতলা পর্যন্ত। 

বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) প্রতিষ্ঠার পর সেই প্রফিট বোনাসে কিছুটা ছেদ পড়ে যায়। আর এতেই চটে গেছেন বিতরণ কোম্পানিগুলোর লোকজন। আর এর অর্থ হচ্ছে মন্ত্রণালয় ক্ষেপে যাওয়ার নামান্তর। কারণ যুগ্ম সচিব থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত প্রত্যেকেই কোনো না কোনো কোম্পানির বোর্ডে রয়েছেন। কেউ কেউ একই সঙ্গে একাধিক কোম্পানির বোর্ডে রয়েছেন।

খোদ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব আছেন সবচেয়ে বড় দুটি কোম্পানির (তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ও কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি) বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে। বহু বছর ধরেই এমনটি চলে আসছে, ব্যক্তির রদবদল হলেও সচিবের জন্য নির্ধারিত এই পদগুলো থেকেই যাচ্ছে। যিনি সচিব হবেন তিনিই বোর্ড চেয়ারম্যান, এটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে।

কোম্পানির বোর্ড সদস্যরা আইনগতভাবে প্রফিট বোনাসের যোগ্য নয়। তবে কর্মকর্তা কর্মচারীদের নামে বরাদ্দকৃত বিশাল অঙ্কের প্রফিট বোনাস থেকে বখরা তুলে উপরতলায় সরবরাহ করা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। দু-একটি ক্ষেত্রে ভিন্ন হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বোর্ড সদস্যদের নাম করে বখরা আদায় করা হয়। বিশাল অঙ্কের বোনাসের জন্য সঙ্গত কারণেই বখরা দিতেও আপত্তি তুলছেন না তারা।

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে গত অর্থবছরে (২০২১-২২) প্রফিট বোনাস দেওয়া হয়েছে ১৮ লাখ টাকা করে, কোম্পানির পিওন ঝাড়ুদার থেকে সকলেই পেয়েছেন ওই অর্থ। কোম্পানিটির ২০তম গ্রেডে চাকরি করা একজন কর্মীর মাসিক বেতন ১০ হাজার টাকার নিচে। তার কাছে এই ১৮ লাখ টাকা কুড়িয়ে পাওয়া অর্থের মতোই। পুরো ১৫ বছরের বেতনের সমান টাকা পেতে বখরাতে কোনো আপত্তি থাকার কথা না।

তবে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে এরকম একটি ঘটনা সামনে এসেছিল। ২০১৬ সালের দিকে তখন প্রত্যেক কর্মীর কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে কেটে রাখা হচ্ছিল। বিষয়টি যাতে প্রকাশ না করেন সে জন্য টাকা কেটে রাখার সময় কোরআন ছুঁয়ে শপথ করানো হচ্ছিল। কয়েকজন অফিসার এতে বাগড়া দিয়ে বসেন। 

এ কারণে টাকা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া ঝুলে রাখলে বিষয়টি প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটিও করা হয়েছিল। যদিও সেই কমিটির রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি।

কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানিতে প্রায় ৪শ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। এখানে ১ লাখ টাকা করে বখরা আদায় করে থাকলে ৪ কোটি, আর ২ লাখ করে আদায় করা হলে হয় ৮ কোটি টাকা। যা বোর্ড সদস্যদের নাম করেই আদায় করা হয়ে থাকে। কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি আয়তন ও লোকবলের দিক থেকে ছোট, তিতাস গ্যাসে রয়েছে ২ হাজার ২শ কর্মকর্তা-কর্মচারী। সেখানকার বিষয়টি কেমন হতে পারে সহজেই অনুমান করা যায়।

বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতের কোম্পানিগুলোতে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা করে প্রফিট বোনাস প্রদান করার বিষয়টি অনেকটাই সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে বিইআরসির ভ‚মিকার কারণে তাতে কিছুটা ছেদ পড়ে যায়। বিইআরসি আইন অনুযায়ী কোম্পানিগুলোকে প্রফিট দেওয়ার সুযোগ নেই। মূল্য নির্ধারণের ফর্মুলা হচ্ছে না লাভ, না লোকসান। বিতরণ কোম্পানিগুলো নয়ছয় হিসেব নিয়ে দাম বাড়াতে এলেও তা ধোপে টেকেনি। যথারীতি তাদের প্রস্তাবনাও বাতিল হয়ে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে প্রফিট বোনাসের উপর।

গ্যাসের দামের বিষয়ে সর্বশেষ গণশুনানি হয় গত বছরের মার্চ। কোম্পানিগুলো গ্যাসের দামের পাশাপাশি বিতরণ চার্জ বাড়িয়ে দেওয়ার আবেদন করেছিল। ওই শুনানিতে বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে সবগুলো কোম্পানিই মুনাফায় রয়েছে। শুনানিতে দেখা যায়, কোম্পানিগুলোর পরিচালন বহিভর্‚ত আয় এত বেশি যে, বিতরণ চার্জ আদায় না করলেও তারা মুনাফায় থাকে। অর্থাৎ হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক আমানত, নানা রকম মাসুল দিয়েই মুনাফায় থাকে কোম্পানি।

এ কারণে শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্নফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কিছুটা মাসুল দেওয়ার মতামত দেয় টেকনিক্যাল কমিটি। কর্ণফুলীর তৎকালীন বিদ্যমান দর ঘনমিটার ২৫ পয়সা থেকে কমিয়ে ৯ পয়সা করার সুপারিশ দেওয়া হয়। অন্যান্য বিতরণ কোম্পানির বিতরণ চার্জ বিলুপ্ত করার সুপারিশ আসে হিসেব থেকে। একমাত্র সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএল বর্তমান চার্জ ৪২ পয়সা থেকে ৬ পয়সা বাড়ানোর সুপারিশ দেওয়া হয়।

পরে জুন মাসে দেওয়া আদেশে ৫ পয়সা বাড়িয়ে ৪৭ পয়সা করা হয়। এ নিয়েও বিস্তর ক্ষোভ প্রকাশ করেছে জিটিসিএল। গত ১৪ ডিসেম্বর আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় জিটিসিএল এমডি বলেন, গত অর্থবছরে তাদের ২১৬ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৫৫০ কোটি টাকা লোকসান হবে।

শুধু প্রফিট বোনাস নয়, এমনও দেখা গেছে কোম্পানির অবস্থান রাজশাহী এলাকায়, তারা বার্ষিক সাধারণ সভার আয়োজন করছে ঢাকার পাঁচতারকা হোটেলে। বিইআরসির গণশুনানিতে এসব বিষয় উঠে আসলে কোম্পানিগুলো বিব্রত অবস্থায় পড়ত। বোর্ড সদস্যদের সুবিধা বাড়িয়ে দেওয়াসহ নানা রকম অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি পড়তে হতো কোম্পানির কর্তাদের। যে কারণে তারা নিজে থেকেই অনেক অনৈতিক চর্চা কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

শুধু গ্যাসের বিতরণ কোম্পানি নয়, বিদ্যুতের বিতরণ কোম্পানির অবস্থাও একই। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ প্রফিট বোনাস প্রদানের শীর্ষে ছিল। কোম্পানিটি প্রায় প্রতিবছরেই ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা করে বোনাস দিয়ে এসেছে। তবে এবার তাদের ছাড়িয়ে গেছে নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি।

অনেকেই মনে করেন প্রফিট বোনাসে হাত পড়ায় কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেজায় নাখোশ। তারা যেহেতু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন, তাই সহজেই কান ভারী করার সুযোগ পান। এমনকি বোর্ড সভায় বসেও তারা তাদের মতো করে ব্যাখ্যা দাঁড় করান। কর্তারাও হয়তো তা তলিয়ে দেখার সময় সুযোগ পান না।

গত ১৪ ডিসেম্বর আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার কার্যপত্রে বিইআরসিকে নিয়ে চর্চার আলামত পাওয়া গেছে। ওই সভায় জিটিসিএল এমডি এবং তিতাস গ্যাস এমডি দাবি করেন তাদের কোম্পানি লোকসান দিচ্ছে। তাদের এমন বক্তব্যের জবাবে জ্বালানি বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিব বলেন, “সরকার, পেট্রোবাংলা কিংবা বিপিসির মুনাফা করার জন্য কখনোই ব্যবসা করে না। তবে কোম্পানিগুলি যে পরিমাণ বিনিয়োগ করবে তা রিটার্নের সুযোগ থাকতে হবে। অন্যথায় কোম্পানিগুলি বিনিয়োগ করে ক্ষতির সম্মুখীন হবে, যা কাঙ্ক্ষিত নয়।”

বিইআরসি সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, প্রফিট বোনাসের নামে হরিলুট ঠেকাতে যাওয়ায় বিপদ ডেকে এনেছে বিইআরসি। বিদ্যুতের দামের পর গ্যাসের দামও নির্বাহী আদেশে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই কোম্পানিগুলোর বিতরণ চার্জও বাড়িয়ে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে।

ক্যাবের সিনিয়র সহসভাপতি ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেছেন, নির্বাহী আদেশে যেভাবে গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে, এর কোনো যৌক্তিকতা ছিল না। এর ভয়াবহ ফল ভোগ করতে হবে। বিইআরসি কিছুটা হলেও দুর্নীতি অনিয়ম রোধে ভূমিকা রাখত। এখন সেই জায়গাটি থাকল না।

এতে করে বেপরোয়া হয়ে উঠবে কোম্পানির লোকজন। সচিব বোর্ডে বসে সিদ্ধান্ত নেবে, তিনিই আবার মন্ত্রণালয়ে বসে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়িয়ে দেবে। গণশুনানিতে অনেক অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো। সেই ভয়ে তারা অনেক অনিয়ম কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এখন সেই জায়গাটিও বন্ধ করে ফেলা হলো।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫