
বিদ্যুৎ সঞ্চালন তার। ছবি: সংগৃহীত
করোনা মহামারি পরবর্তী প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারলেও এখনো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। এই যুদ্ধের ফলে জ্বালানি খাতে সৃষ্ট সংকট থেকেও বেরিয়ে আসতে পারছে না বাংলাদেশ। সংকট কাটাতে নানা পদক্ষেপ নিলেও শিগগিরই কোনো সুখবর পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু আসন্ন গ্রীষ্ম ও সেচ মৌসুমে রমজান শুরু হওয়ায় সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার শঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
গত বছরের মতো পরিস্থিতি এড়াতে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানির তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পিডিবি বলছে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য ভর্তুকি প্রয়োজন ৪০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বিইআরসি পাইকারি মূল্যবৃদ্ধিতে ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব নয়। উপরন্তু গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ ১ টাকার মতো বেড়ে যাওয়ায় ভর্তুকি ৫০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে। অন্যদিকে ডলার সংকটে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে ১৮ দিনের ব্যবধানে দুবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ পাইকারিতে ৮ শতাংশ আর খুচরায় ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এরপরও নাখোশ বিতরণ সংস্থাগুলো। তারা বলছে, তাদের কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। দাম আরও অন্তত ১০ শতাংশ বাড়ানো প্রয়োজন। এজন্য তারা শিগগির বিদ্যুৎ বিভাগে আবেদন করবে।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সেচ মৌসুম শুরু হয়, যা ৩১ মে পর্যন্ত চালু থাকে। এ সময় বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। এ সময়টাতেই থাকে গ্রীষ্মকাল। তার ওপর এবার রোজা শুরু হচ্ছে ২৩ মার্চ থেকে। সে হিসাবে মার্চ এবং এপ্রিল মাসে সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা থাকবে সর্বোচ্চ। জ্বালানির অভাবে গত বছর টানা কয়েক মাস লোডশেডিং দিতে হয়েছে। গত বছর সেচ মৌসুম এপ্রিল ২০২২ মাসে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। আসছে সেচ মৌসুমে বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদা ধরা হয়েছে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। গত বছর গড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। এ বছর ন্যূনতম ১ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস লাগবে, যদিও চাহিদা ১ হাজার ৬০০ মিলিয়ন। গত সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১ হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ পাওয়া গেছে মাত্র ১ হাজার ৩১ মিলিয়ন ঘনফুট।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শীতকালে বিদ্যুতের উৎপাদন ও চাহিদা কম থাকে। তারপরও জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে লোডশেডিং করা হচ্ছে। বর্তমানে সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১ হাজার মেগাওয়াট, উৎপাদিত হচ্ছে ৯০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি। গরমের সময়ে চাহিদা ১৪-১৫ হাজার মেগাওয়াটে গিয়ে ঠেকে। গত বছর ১২ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হয়েছে। এখন কয়লার অভাবে বন্ধ রয়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি ছাড়া সংকট নিরসন হবে না। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে উভয় সংকট তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে আগামী গ্রীষ্মে লোডশেডিং মোকাবিলা করতে সরকার ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে রাখার যে পরিকল্পনা করেছিল তার মধ্যে রয়েছে পায়রা ও রামপাল কেন্দ্র। কয়লার অভাবে দেশের বড় এই দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এজন্য চলতি মাসের শুরু থেকেই ফিরেছে লোডশেডিং। বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের সংকটের কারণে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) বা ঋণপত্র খুলতে পারছে না এ দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার টাকা ১২ মাস বাকি পড়েছে। ডলার সংকটের কারণে এই অর্থ দেওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া এখনই এলসি খুললে কয়লা আসতে কম করে হলেও ৪০ দিন লাগবে বলে জানা গেছে। শুধু এ দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, অন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এছাড়া পিডিবির কাছে কয়েক মাসের বকেয়া রয়েছে কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এবং তেলভিত্তিক বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের। ডলার সংকটের কারণে এসব কেন্দ্রের বিল ও জ্বালানি খরচ দিতে পারছে না পিডিবি। কেন্দ্রগুলো বিদেশ থেকে কয়লা আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলারের জোগানও পাচ্ছে না। এমনকি তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোরও তেল আমদানি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষকরা এভাবেই নিজেদের আশঙ্কার কথা জানালেন এই প্রতিবেদককে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছর থেকে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দেয় সরকার। এ সময় তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদনও কমানো হয়। নেওয়া হয় সাশ্রয়ী বিভিন্ন পদক্ষেপ। ফলে গত গ্রীষ্মে ৩ হাজার মেগাওয়াটের অধিক লোডশেডিং করতে হয়। তখন বলা হয়েছিল শীতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে আর আগামী গ্রীষ্মের আগেই কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসবে। এতে গ্রীষ্মে লোডশেডিং সামাল দিতে পারবে সরকার। কিন্তু গরম শুরু হওয়ার আগেই বড় দুটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র রামপাল ও পায়রার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গত বছরের পরিস্থিতির দিকেই যাওয়ার ইঙ্গিত বলে মনে করছেন তারা।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, শিগগিরই বিদ্যুতে সুখবর পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ডলার সংকট হলেও প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করতেই হবে। কয়েক কার্গো এলএনজি ও কয়লা আমদানি করতে হবে। এর বিকল্প নেই। এলএনজি ও কয়লা আমদানি করতে না পারলে আসন্ন গ্রীষ্মকালে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কম ছিল, তাই যে সুবিধা পাওয়া গেছে তা গরম শুরু হলে থাকবে না।
তিনি বলেন, প্রতি বছর প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। দরকারের সময় তেলভিত্তিক কেন্দ্র চালু করেও সংকট সামাল দেওয়া যাবে না। এ বছরও গত বছরের মতো পরিস্থিতি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
পিডিবির বোর্ড সদস্য (অর্থ) সেখ আকতার হোসেন বলেন, ভর্তুকির যে টাকা চাওয়া হয়েছে তা না দেওয়া হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হবে না। এটি তো পরিষ্কার।
এদিকে কয়েকদিন আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, চলতি বছরটি আমাদের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের বছর। আগামী মাস থেকে সেচ মৌসুম, তারপর রোজার মাস শুরু হবে। বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের দামের অবস্থাও ঊর্ধ্বমুখী। সবকিছু মাথায় নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে। সামনের মাস থেকে যেহেতু সেচ শুরু শুরু হবে, সেখানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চলমান সংকটকালে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে হাসপাতাল, সেচ, শিল্প ও সার কারখানাগুলো অগ্রাধিকার পাবে।
সবমিলিয়ে বিশেষজ্ঞরাও বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণের বিষয়ে কোনো আশার আলো দেখছেন না বলে জানিয়েছেন এই প্রতিবেদককে।