Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

নিপাহ ভাইরাসের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

Icon

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৫:২৩

নিপাহ ভাইরাসের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

নিপাহ ভাইরাস। প্রতীকী ছবি

নিপাহ ভাইরাসের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটি বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। এই ভাইরাসটি করোনা ভাইরাসের চেয়ে অনেকে বেশি শক্তিশালী। ভাইরাসটিতে এখন পর্যন্ত কোনো রূপান্তর ঘটেনি। তবে যেহেতু এটি ভাইরাস, তাই যে কোনো সময় রূপান্তর ঘটতেও পারে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর স্বাস্থ্য বিভাগ ভবিষ্যতে করোনার মতো ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের তালিকায় নিপাহকে রেখেছে। ভাইরাসটির উৎপত্তি মালয়েশিয়া হলেও অদ্ভুত রকমভাবে বাংলাদেশে চলে এসেছে। মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ থাকলেও সেসব দেশে এই ভাইরাসটির অস্তিত্ব নেই।

নিপাহ ভাইরাসে কোনো কোনো সময় আক্রান্তদের শতভাগ মৃত্যু হয়ে থাকে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত আক্রান্তদের ৭০ শতাংশের বেশি মৃত্যু হয়েছে। ২০১১ সালে লালমনিরহাট জেলায় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ২২ জনের মধ্যে ২১ জনেরই মৃত্যু হয়। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমণ হয়ে থাকে। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। 

দেশে ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৩২৬ জন ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হয়েছে এবং ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৩১ জনের প্রাণহানি হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বব্যাপী নিপাহ ভাইরাসে মৃত্যুর হার ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশের মধ্যে হলে বাংলাদেশে তা ৭১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। 

বাংলাদেশের ৩০ জেলায় ভাইরাসটির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তবে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছয় জেলায় ১০ জন ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যু হয়েছে সাতজনের। এই কদিনে আক্রান্তদের মৃত্যু হার ৭০ শতাংশ। আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, ২০২২ সালে করোনা সংক্রমণের সময় দেশে তিনজন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল। এর মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত এই দুজনই নওগাঁ জেলার বাসিন্দা এবং তারা নারী। 

নিপাহ হলে যেসব জটিলতা 

আইসিডিডিআরবি বলছে, বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত নারীদের জন্য গর্ভাবস্থার শেষের দিকে জটিলতা সৃষ্টি করে; সুস্থ হয়ে গেলেও ভূমিষ্ঠ সন্তানের দেহে নিপাহ ভাইরাসের অ্যান্টিবডি পাওয়া যাচ্ছে। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মস্তিষ্কে ভয়াবহ প্রদাহ দেখা দেয়। রোগী জ্বর ও মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন। এক পর্যায়ে খিঁচুনিও দেখা দিতে পারে। জ্বর, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট ছাড়াও কাশি, বমি, ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করতে না পারলে রোগীর মৃত্যু ঘটে থাকে।

নিপাহ ভাইরাস মোকাবিলায় সরকার একটি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে রাজধানীর মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে ১০টি আইসোলেশন এবং ১০টি আইসিইউ বেড প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যেন জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলেছে, আক্রান্ত ও মৃত্যু যা-ই হোক এই ভাইরাসে পুরো দেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এবার শীত মৌসুমের শুরু থেকেই বিভিন্ন স্থানে নিপাহ ভাইরাস নিয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এ ভাইরাসটি বাদুড়ের লালায় থাকে, কিন্তু বাদুড়ের কোনো ক্ষতি করে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খেজুরের কাঁচা রস পানে মানুষ ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হয়ে থাকে। এর বাইরে গাছের নিচে পড়ে থাকা অর্ধ খাওয়া ফল খেলেও নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে।

বর্তমান পরিস্থিতি

গত ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজশাহী, নওগাঁ, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, পাবনা ও নাটোর জেলার ১০ জন নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে বলে আইইডিসিআর জানিয়েছে। এই জেলাগুলোর মধ্যে রাজশাহীর গোদাগাড়িতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। নওগাঁ সদরে দুজন আক্রান্ত হলেও মৃত্যু হয়েছে একজনের। রাজবাড়ীর বালিকান্দীতে তিনজন আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে দুইজনের এবং রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ, পাবনার ঈশ্বরদী ও নাটোরের বাগাতিপাড়ায় একজন করে আক্রান্ত হয়েছে এবং তাদের মৃত্যু হয়েছে। শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে একজন আক্রান্ত হয়েছেন। 

আইইডিসিআর জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ছয়জন পুরুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে চারজন মারা গেছে। চারজন নারীর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। 

বাদুড় থেকে যেভাবে রসে ভাইরাস

আইইডিসিআর বলছে, খেজুরের রসে মিশে যাওয়া বাদুড়ের লালা থেকে মানবদেহে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমিত হয়। শুধু রস বা পাখির খাওয়া ফল নয়, আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলেও নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। খেজুরের রস গাছের যে অংশ থেকে বের হতে থাকে সেখানে রাতের বেলা বাদুড় চেটে রস পান করে। রসের অবশিষ্ট নিচের হাঁড়িতে গিয়ে জমা হয়। এ রস নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাঁচা পান করলেই নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। 

খেজুরের কাঁচা রাস পান করার ঐতিহ্য বাংলাদেশের অনেক পুরনো। কিন্তু ঘটা করে উৎসব পালন ও মিডিয়ায় প্রচার করার ঘটনা ঘটছে কয়েক বছর থেকে। বিশেষ করে শীতের যে সময়ে খেজুর রস আসতে শুরু করে (জানুয়ারির প্রথম দিকে) সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা কেন্দ্রিক খেজুরের কাঁচা রস পানের একটি উৎসব পালন করা হচ্ছে।

জীবাণু নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর এ ধরনের উৎসব পালন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। আইইডিসিআর বলছে, অনেকেই জাল দিয়ে ঘিরে অথবা বাঁশের চাটাই অথবা বাঁশের বানা, ছালা দিয়ে গাছের যে অংশে রস পড়ে তা ঢেকে রাখে যেন বাদুড় না বসতে পারে। কিন্তু অনেক সময় বাদুড় রসে বসতে না পেরে প্রস্রাব করে দিয়ে যায়।

বাদুড়ের প্রস্রাবেও ভাইরাস থাকে। সে কারণে কাঁচা রস পান করতে নিষেধ করা হয়েছে। আইইডিসিআরের চিকিৎসকরা বলছেন, রস গরম করে পান করতে হবে। সংস্থাটির গবেষকরা গোপন ক্যামেরার মাধ্যমে দেখতে পেয়েছেন যে, রসের হাঁড়ির চারপাশ জাল বা চাটাই দিয়ে ঢেকে দিলেও বাদুড় কলসির মুখ বরাবর প্রস্রাব করে। ওই বেড়া দিয়ে বাদুড়ের রস খাওয়া প্রতিরোধ করা গেলেও ওই প্রস্রাবের গতি ঠেকানো যায় না। ফলে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।

নিপাহ ভাইরাসের ইতিহাস

১৯৯৮ সালে প্রথম মালয়েশিয়ার শূকর ও শূকর লালন-পালনকারীদের মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। প্রথমে অজ্ঞাত হিসেবেই মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় ১০৫ জনের মৃত্যুসহ ২৫৬ জনের মস্তিষ্কে সংক্রমণ ঘটে এবং এর পাশের দেশ সিঙ্গাপুরে একজনের মৃত্যু ও ১১ জনের মস্তিষ্কে সংক্রমণ ঘটে। এদের সবারই শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দেয়। 

বাংলাদেশে ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় প্রথম ভাইরাসটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এটা আসে ভারত থেকে। এ পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসের প্রকোপ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাংলাদেশেই এই ভাইরাসের সংক্রমণে সর্বাধিক মৃত্যু ঘটেছে। সাধারণত শীতকালে বাংলাদেশে এই ভাইরাসের প্রকোপ ঘটে। ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলার সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শিলিগুড়িতে এই ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৫ সালে নওগাঁ, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও টাঙ্গাইল জেলায় এই রোগের প্রকোপ ঘটে। 

২০১৮ সালের মে মাসে ভারতের কেরালা রাজ্যের কোঝিকোড় জেলায় এই রোগের নতুন প্রকোপ ঘটে। এর ফলে একজন চিকিৎসক ও একজন নার্সসহ ১৩ জনের মৃত্যু ঘটে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫