Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

কোন পথে দুদক

Icon

শাহরিয়ার হোসাইন

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:০৯

কোন পথে দুদক

দুর্নীতি দমন কমিশন। ছবি: সংগৃহীত

ব্যুরো অধ্যায় শেষে ১৮ বছরেরও বেশি সময় আগে প্রতিষ্ঠিত হয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনেক প্রত‌্যাশা সামনে রেখে সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হলেও দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারেনি। যদিও সক্ষমতা বেড়েছে, কিন্তু দুর্নীতি দমনে আন্তরিক প্রচেষ্টার স্বাক্ষর সংস্থাটি রাখতে পারেনি বলে মনে করেন বোদ্ধা মহল। বরং ‘নখ-দন্তহীন’ উপাধি পেয়েছে সংস্থাটি। 

সম্প্রতি পরিসংখ‌্যান বলছে কাজের সূচকে কেবলই পেছাচ্ছে দুদক। অভিযোগ জমার হার বাড়লেও অনুসন্ধান, মামলা ও চার্জশিট অনুমোদনের সংখ্যা কমেছে। দুর্নীতির বিষয়টি জোরেশোরে উচ্চারিত হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোনো রাঘববোয়ালকে ছুঁতে পারেনি সংস্থাটি।

রাজনৈতিক প্রভাবে অনেকের বিরুদ্ধে যেমন দুদকের মামলার অভিযোগ আছে, তেমনি একই বিবেচনায় অনেককে রেহাই দেওয়ার অভিযোগও পুরনো। ক্ষমতাধর দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে দুদককে সক্রিয় দেখা যায় না। স্বায়ত্তশাসিত হলেও দুদক রাজনীতির প্রভাবের বাইরে যেতে পারেনি বলেও ধারণা বিশেষজ্ঞসহ সাধারণ মানুষের। 

কাজ পেছাচ্ছে
দুদকের কাজের বেশিরভাগ সূচকই নিম্নগামী বলে জানা গেছে। কয়েক দফায় প্রতিষ্ঠানটির জনবল বাড়লেও কাজের ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়েনি। সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে দুদকে অভিযোগের সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে, বিপরীতে এসবের অনুসন্ধান, মামলা ও চার্জশিটের সংখ্যা কমেছে। সম্পদ সংক্রান্ত অনুসন্ধান কার্যক্রমের পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে নিম্নগতি।

এছাড়া ফাঁদ মামলার সংখ্যাও আগের চেয়ে কমে গেছে। পাঁচ বছরে দুদকের দায়ের করা শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ মামলার আসামি খালাস পেয়েছে। তিন বছরে প্রায় দেড় হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দায়মুক্তি পেয়েছে। এদের অধিকাংশই প্রভাবশালী। 

দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২০ সালে অভিযোগ জমা পড়ে ১৮ হাজার ৪৮৯টি। এর মধ্যে অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয় মাত্র ৮২২টি। আর ২ হাজার ৪৬৯টি অভিযোগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দায় মেটায় দুদক। ২০২১ সালে (করোনা মহামারির বছর) জমা ১৪ হাজার ৭৮৯টি অভিযোগ থেকে অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয় মাত্র ৫৩৩টি। আর ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় ২ হাজার ৮৮৯টি।

২০২২ সালে জমা পড়া অভিযোগের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৩৩৮টিতে। এগুলো থেকে অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয় ৯০১টি। আর বাকি ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগের বিষয়ে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করে দুদক। গত ৫ বছরের প্রাপ্ত অভিযোগ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালে সর্বাধিক সংখ্যক অভিযোগ জমা পড়ে। এই বছরই সর্বোচ্চ সংখ্যক অভিযোগের অুনসন্ধান নিজেরা না করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া কিংবা তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থায় পাঠিয়ে কাজ শেষ করে কমিশন।

এদিকে গত ৫ বছরে মামলার সূচকে ওঠানামা লক্ষ করা গেছে। গত পাঁচ বছরে মামলার বিপরীতে চার্জশিট অনুমোদনের পরিসংখ্যানও নিম্নমুখী। দুই বছর চার্জশিটের সংখ্যা সামান্য বাড়লেও তিন বছরই কমেছে। ২০১৮ সালে ২৩৬টি, ২০১৯ সালে ২৬৭টি, ২০২০ সালে ২২৮টি, ২০২১ সালে ২৬০টি এবং ২০২২ সালে ২২৪টি চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে কমিশন।

এক সময় ফাঁদ পেতে দুর্নীতিবাজ ও ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তাদের ধরতে দুদকের পদক্ষেপটি বেশ আলোচিত ছিল। গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে ফাঁদ মামলার সংখ্যাও কমেছে। অথচ ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দুদকের সব অফিস মিলিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা এক হাজার ১৭৪ জন। দুই বছর আগেও এই সংখ্যা অর্ধেকের কিছু বেশি ছিল।

দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, করোনার প্রভাব বার্ষিক পরিসংখ্যানে পড়েছে। তবে কাজের সূচক প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে একই রকম থাকবে সেটাও ঠিক নয়। আর যে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের কাছ থেকে সুফল পেতে আরও সময় লাগবে।

রাজনৈতিক প্রভাব
জানা গেছে, তদবির ও রাজনৈতিক প্রভাবেই প্রতিবছর অসংখ্য অভিযোগ নথিভুক্ত হয়। অভিযোগের সত্যতা থাকার পরও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন না দিয়ে দায়মুক্তি (ক্লিনচিট) দেওয়া হয়। গত তিন বছরে এ ধরনের প্রায় দেড় হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দায়মুক্তি পেয়েছে। এদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী, সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, মেয়র, সচিব, পুলিশ, ব্যাংক কর্মকর্তা, ওয়াসা, রাজউক, গণপূর্ত, বাপেক্স, তিতাসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রয়েছেন। 

এদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দায়মুক্তি পেয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাস থেকে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের উপর একটি বিস্তারিত গবেষণা করেছে দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সেই গবেষণার ভিত্তিতে টিআইবির পরিচালক রিজওয়ানুল আলম বলছিলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের উপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ লক্ষ করা যায়। তবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অনেক সময় প্রভাবের কারণে দুদকের কাজের গতি কমে। তবে যেহেতু প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা বেশি সেহেতু তাদের রক্ষার চেষ্টা দুদকের ভেতরে রয়েছে কিনা- তাও ভাবনার বিষয়। 

সমালোচনা ও বিতর্কে দুদক
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির মতো বেশ কিছু বিষয়ে দুদকের কার্যক্রমে জনমনে বিরাট সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করে। এই ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেংকারির ঘটনা অনুসন্ধান করে দুদক। এমনকি অনুসন্ধান শেষে ৬১টি মামলাও করা হয়। কিন্তু ব্যাংকটির চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে কোনো একটি মামলায়ও আসামি করা হয়নি। এমনকি পর্ষদের কাউকেও না। এ নিয়ে দুদক সমালোচনায় পড়ে। অবশ্য পরে দুদক আবদুল হাই বাচ্চুকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলার শিকার হয়েছেন। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং কিছু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। 

২০২১ সালে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়াসহ দুর্নীতির বিভিন্ন ঘটনা তদন্ত করে আলোচনায় এসেছিলেন দুদকের সমন্বিত চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ে উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন। পরে তাকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়। এক পর্যায়ে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।

শরীফ উদ্দিনকে অপসারণের বিষয়টি চরম সমালোচনার জন্ম দেয়। চাকরিচ্যুত উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন দুদক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনেছেন। তিনি বলেছিলেন, বড় বড় কয়েকটি দুর্নীতির মামলার তদন্ত করে তিনি অনেক আমলা ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছিলেন। সেজন্য তিনি প্রভাবশালী মহলের রোষানলের শিকার হয়েছেন। তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে দুদকের পক্ষ থেকে।

আলোচিত মামলা
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের উচ্চপর্যায়ের লোককে জবাবদিহিতার আওতায় আনার চেষ্টা করেছে দুদক। এর মধ্যে ছিল ২০০৯ সালের সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের মামলা করা। এই কমিশনের সময়ে গণমাধ্যমে ডেসটিনি ও হলমার্কের জালিয়াতি এবং দুর্নীতি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শেষে মামলা করে। 

তারা অভিযোগ করেন, দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে তারা নানা হয়রানির শিকার হন। কিন্তু দুদক তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত না করে একজন কর্মকর্তাকে অপসারণ করে উদাহরণ সৃষ্টি করল। সরকারদলীয় সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও হাজী মোহাম্মদ সেলিমকেও শাস্তি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

যেভাবে যাত্রা দুদকের 
২০০৪ সালের আগে দুর্নীতি দমন ব্যুরো ছিল। দুর্নীতি দমন ব্যুরোর কাছ থেকে আশানুরূপ কাজ না পেয়ে দেশের মানুষ হতাশ হয়। দুর্নীতি দমন ব্যুরোর কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করে দাতা সংস্থাও। রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থেকে একটি স্বাধীন সংস্থা যাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে সেজন্য ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’ বিলুপ্ত করে ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’ প্রতিষ্ঠার চাপ ছিল। 

এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার নতুন একটি আইন করে। ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করে। কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকে। আর কমিশনার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এম মনিরুজ্জামান মিঞা ও অডিট বিভাগের মনির উদ্দিন আহমেদকে নিয়োগ দেয় সরকার। কমিশন গঠনের ফলে তাদের কাছে সবার প্রত্যাশা বেড়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, ওই সরকার তাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার হিসেবে কমিশন বা দুদক গঠন করলেও এর বিধিবিধান বা অর্গানোগ্রাম করে দেয়নি। এ জন্য শুরুতেই কাজ করতে গিয়ে হোঁচট খায় প্রতিষ্ঠানটি। 

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দুদক চেয়ারম্যান লে. জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরী পদত্যাগ করে চলে যান। সরকার হাসান মশহুদ চৌধুরীর স্থলাভিষিক্ত করে সচিব গোলাম রহমানকে। এরপর আরেক অবসরপ্রাপ্ত আমলা ইকবাল মাহমুদকে দুদক চেয়ারম‌্যান করা হয়। সর্বশেষ দুদকের চেয়ারম‌্যান হন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫