Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ

শুরুতেই শুভঙ্করের ফাঁকি

Icon

মনজুরুল হক

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:২১

শুরুতেই শুভঙ্করের ফাঁকি

দেশে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সরকারের একাধিক পদক্ষেপের পর সাব্যস্ত হয়েছিল সরকার ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ কিনবে। আদানি গ্রুপ তাদের যে বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানি করবে, সেই কেন্দ্রের জন্য কয়লার দাম বেশি ধরতে চায় তারা; যা চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের সময় অপ্রকাশ্য ছিল। আদানি কয়লার দাম বেশি ধরলে বাংলাদেশকে অনেকটা বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। 

সূত্রমতে, আদানি গ্রুপ প্রতিটন কয়লার দাম ধরতে চায় ৪০০ ডলার। এই দরে কয়লা আমদানির ঋণপত্র খোলার কথা তারা জানিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে। অথচ বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত রামপাল এবং বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে করা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লার দাম পড়ছে প্রতি টন ২৫০ ডলারের মতো। কিন্তু আদানি প্রতি টন কয়লার যে দাম প্রস্তাব করেছে, তা রামপাল ও পায়রার চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি।

তাই আদানির প্রস্তাবিত কয়লার দাম নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে পিডিবি। সে অনুযায়ী আদানির একটি কারিগরি প্রতিনিধি দল আলোচনা করতে ঢাকায় আসবে। তারা কয়লার দাম পুনর্মূল্যায়নে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে।

এ ধরণের চুক্তির বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে যখন হিনডেনবার্গের প্রতিবেদন সামনে এলো। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি অভিযোগ করেছে, মরিশাসভিত্তিক ইলারা তার বাজারমূল্যের ৯৯ শতাংশ আদানির তিনটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে- মোনার্চে আদানির একটি প্রতিষ্ঠানের কিছু মালিকানা রয়েছে। মোনার্চ আগে আদানি গোষ্ঠীর হিসাব রক্ষণাবেক্ষণের কাজ দেখভাল করত।

আদানি বলেছে, ওই প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ সঠিক নয়। হিনডেনবার্গের প্রতিবেদনের পর আদানি গোষ্ঠীর সম্পদমূল্য কমতে থাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ জাতীয় পর্যায়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিরোধী দলগুলো হিনডেনবার্গের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পার্লামেন্টে স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছে। আর তার পরপরই বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগ নড়েচড়ে বসেছে।

দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ২২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। ফলে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রকেই অলস বসে থাকতে হচ্ছে। যদিও বসে থাকলেও তারা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট পাচ্ছে। বছরে এর পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়াতে জোর দেয়। একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগ করা হয়। পাশাপাশি ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এখন ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে। আদানির সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৭ সালে। চুক্তির পর আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ শুরু করে।

এ নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদেও বিরোধী দল জাতীয় পার্টি আদানির কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এর আগে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানির ক্ষেত্রে আদানির সঙ্গে চুক্তি নিয়ে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচীকে। ২ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি একটি সার্বভৌম সরকারের সঙ্গে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। এর সঙ্গে ভারত সরকারের সংস্রব নেই বলে তার ধারণা।

সরকার অনুমোদিত সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করে পিডিবি। এ চুক্তিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য উল্লেখ না থাকলেও একটি সূত্র দেওয়া থাকে। সেই সূত্র অনুসারে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া (ক্যাপাসিটি পেমেন্ট) নির্ধারিত থাকে। আর পরিচালন ও জ্বালানি খরচের বিষয়টি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্র নিজেরা জ্বালানি কিনে ব্যবহার করলেও তার ক্রয় রসিদ দেখে বিদ্যুৎ বিলের সঙ্গে জ্বালানি মূল্য পরিশোধ করতে হয় পিডিবিকে। জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দামও বেড়ে যায়।

কয়লার দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল ইনডেক্স ও ইন্দোনেশিয়ার ইনডেক্স  বিবেচনায় নেওয়া হয়। তাদের কয়লার দাম নিয়মিত অনলাইন সূচকে প্রকাশ করা হয়। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ঘোষিত দামের আড়ালে বিশেষ ছাড় থাকে। কয়লা কেনার সময় সমঝোতার ওপর ছাড়ের বিষয়টি নির্ভর করে। গড় দাম ধরার মাধ্যমে কয়লা কিনে পিডিবির কাছ থেকে বাড়তি দাম নিতে পারে আদানি। এ ছাড়া ছাড়কৃত দাম না দেখিয়ে সূচকে প্রকাশিত দর ধরে বিদ্যুতের দাম চাইতে পারে আদানি। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর আগেই বিষয়টি সমাধান করতে চাইছেন তারা। 

পায়রা এবং গত মাসে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। এতে কয়লা আমদানির বিষয়ে এখন পিডিবির একটা ধারণা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার বিষয়ে বেশ তাড়াহুড়া করে চুক্তি সই করা হয়েছে। দামের বিষয়টি চুক্তি সইয়ের সময় ভালো করে দেখা উচিত ছিল। কয়লার দাম বেশি বলে পিডিবি বিদ্যুৎ না নিলেও আদানিকে কেন্দ্রভাড়া পরিশোধ করতে হবে। ভারতে মুক্তবাজারে বিদ্যুৎ বিক্রির সুযোগ আছে। তাই আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কেন্দ্রভাড়া রাখা কোনোভাবেই ন্যায্য হয়নি ।

আদানি গ্রুপের এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিষয়ক ১৬৩ পৃষ্ঠার ‘গোপন চুক্তি’ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন গণমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।

গত ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনটি মূলত আদানি গ্রুপের কয়লাভিত্তিক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে। এর একটি বড় অংশজুড়ে আছে আদানি গ্রুপের কয়লাভিত্তিক ব্যবসা, যার একটি গোড্ডা বিদ্যুৎ প্রকল্প। ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে অবস্থিত এই প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ রপ্তানি হবে বাংলাদেশে।

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের জুনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে ভারতের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই করে।

নরেন্দ্র মোদির এই সফরের পর ভারতের বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ গৌতম আদানির সঙ্গে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে গোড্ডায় ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করে।

ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের প্রতিবেদনে বলছে, এই বিদ্যুৎ বিষয়ক চুক্তিটি প্রথমে বাংলাদেশ ও ভারত ‘উভয়ের জন্য লাভজনক’ মনে হলেও আসলে তা বাংলাদেশের জন্য ‘খুবই কম লাভজনক’।

প্রতিবেদন বলছে, এটি ছিল নরেন্দ্র মোদির ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতিকে শক্তিশালী করার ও ভারতীয় ব্যবসা প্রচারের একটি সুযোগ।

এখন দেখা যাচ্ছে গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার পর কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও আদানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বছরে প্রায় সাড়ে ৪০০ মিলিয়ন ডলার দিতে হবে বাংলাদেশকে। বিদ্যুৎ খাতের বৈশ্বিক মান অনুসারে যা ‘উচ্চমূল্য’ এবং ডলার সংকটের এই সময়ে বাড়তি চাপের বোঝা।

বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, কয়লা ও গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে এখন সর্বোচ্চ চাহিদার তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে উল্লেখ করে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন বলছে, ভারতের এই বিদ্যুৎ বাংলাদেশে প্রয়োজন নাও হতে পারে।

চুক্তি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, এই কয়লা আসতে পারে আদানির মালিকানাধীন ভারতের পূর্বাঞ্চলের একটি বন্দরে। এরপর সেখান থেকে তা আদানির নির্মিত রেলে পৌঁছাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ আদানি হাই-ভোল্টেজ লাইনের মাধ্যমে আসবে বাংলাদেশ সীমান্তে। আর এই সব পরিবহনের খরচ বহন করবে বাংলাদেশ।

এই চুক্তি অনুযায়ী দেশের পাইকারি বিদ্যুতের বাজার মূল্যের ৫ গুণেরও বেশি দামে আদানির বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ। এমনকি কয়লার দাম ইউক্রেন যুদ্ধের আগের পর্যায়ে ফিরে গেলেও অভ্যন্তরীণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যে খরচ সরকার দেখায়, তার চেয়ে অন্তত ৩৩ শতাংশ বেশি দামে এই বিদ্যুৎ কিনতে হবে। বাংলাদেশের কাপ্তাই সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় আদানির বিদ্যুতের দাম পড়বে ৫ গুণ বেশি।

বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আগস্ট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবে। তবে এর সঞ্চালন লাইনটি এখনো প্রস্তুত নয় এবং ডিসেম্বরের আগে কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। ফলে বিদ্যুৎ পাওয়ার আগেই ওই কেন্দ্রের ভাড়া গোনা শুরু হবে।

‘আদানি গোড্ডা কোল পাওয়ার প্ল্যান্ট : অ্যান অ্যাকিলিস হিল অব দ্য পাওয়ার সেক্টর অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ মাসের ক্যাপাসিটি চার্জ হবে ১৪১ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা।

২০১৭ সালে সই হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, বিশ্বের পঞ্চম ধনী ব্যক্তি আদানি গৌতম প্রতিষ্ঠিত আদানি গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্টের ইউনিটপ্রতি ক্যাপাসিটি চার্জ ৩ টাকা ২৬ পয়সা। তবে বাংলাদেশে একই ধরনের প্ল্যান্টের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ ২ টাকা ৮৩ পয়সা।

মহামারির কারণে আদানি গ্রুপের কাজ শুরুর সময় অন্তত ৬ মাস পিছিয়েছে। আগামী আগস্টে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ দুটি প্রতিষ্ঠানের করা ওই গবেষণা।

তবে এরই মধ্যে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘বিদ্যুৎ নেই, কোনো পেমেন্টও নেই’- সরকারের এই নীতি বড় আকারের স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদকদের জন্য প্রযোজ্য নয়। আমরা যদি এই নীতি অনুসরণ করি, তাহলে কেউই প্ল্যান্ট তৈরি করতে রাজি হবে না। যেহেতু আদানি বিনিয়োগ করবে, সেহেতু ন্যূনতম একটা পেমেন্ট তো তাদেরকে করতে হবে। আমাদের জন্য তারা প্ল্যান্ট বানাচ্ছে। যদি আমরা বিদ্যুৎ না নেই, তাহলে তো তারা সমস্যায় পড়বে।’

এরপর আর কার্যত কোনো কথা থাকে না, কেননা বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী, পিডিবি এবং সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে জনগণের কথা আমলে নেওয়ার অতীত নজির খুব একটা নেই। তার মানে দাঁড়াচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ হোক বা না হোক ভারতীয় কোম্পানি আদানি গ্রুপকে বছরে প্রায় সাড়ে ৪০০ মিলিয়ন ডলার দিতে হবে বাংলাদেশকে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫