
পশুপ্রেমীদের দাবির মুখে রাজধানীসহ সারাদেশে কুকুর নিধন বন্ধ রয়েছে। কাজটি আপাতদৃষ্টিতে অমানবিক হলেও এক সময় সিটি কর্পোরেশন অথবা পৌরসভার মালিকহীন নিধন কার্যক্রমের মাধ্যমে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হতো।
কুকুর দলবেঁধে শিশুদের এমনকি বড়দেরও তাড়া করছে- এমন ঘটনা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিত্য-নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কুকুর নিধনে সরকারের আইন আর আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ফলে ‘নিধন’ বন্ধ হয়ে গেছে ২০১২ সাল থেকেই। পরিবর্তে বিচ্ছিন্ন ও অনিয়মিতভাবে চালু হয়েছে কুকুরের বন্ধ্যা ও জলাতঙ্ক রোগের টিকা দেয়া কর্মসূচি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, কুকুরের কামড়ে বিশ্বে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। ওয়ার্ল্ড সোসাইটি ফর দ্য প্রোটেকশন অব এনিম্যালস বলছে, জলাতঙ্ক রোগ মোকাবেলায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বছরে দুই কোটি কুকুর মারা যায়।
রাজধানীতে প্রতিদিনই কোনো না কোনো মহল্লায় কুকুরের কামড়ে আহত হচ্ছেন নারী, শিশু কিংবা বয়স্করা। বাসাবাড়িতে ঢুকে তরকারির পাতিলে মুখ দেয়া, গোশত নিয়ে বাজার থেকে ফিরলে পেছনে থেকে ব্যাগ কামড়ে নিয়ে যাওয়া, দুই দল কুকুরের ঝগড়ায় পড়ে আহত হওয়ার ঘটনা রাজধানী ঢাকায় এখন নিত্য দৃশ্য।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের হিসাবে, রাজধানীতে ৬০ হাজারের কাছাকাছি মালিকহীন কুকুর থাকার কথা বলা হলেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের কোনো কোনো কর্মকর্তার ধারণা, ঢাকায় দেড় লাখেরও বেশি মালিকহীন কুকুর রয়েছে। তবে নগরবাসীর ধারণা এ সংখ্যা আরো বেশি। একটি মাদি কুকুর বছরে আটটি পর্যন্ত বাচ্চা দিতে পারে। কুকুর মারা বন্ধ, আবার বন্ধ্যাকরণও অনিয়মিত, তাই কুকুরের সংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়েছে।
তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও জলাতঙ্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ জানিয়েছেন, রাজধানীতে এ মুহূর্তে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার কুকুর রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের অক্টোবরে রাজধানীর কুকুর গণনা করা হয়।
তিনি জানান, আগে বাংলাদেশে বছরে দুই হাজারের বেশি মানুষ জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে মারা যেত। এখন এ সংখ্যা কমে এসেছে ১০০ জনের নিচে। জলাতঙ্কে মৃত্যু প্রতি ১০ হাজারে একজনের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
তিনি আরো জানান, ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে জলাতঙ্ক দূরীকরণে সরকার কাজ করছে। এ পর্যন্ত ৫৩টি জেলায় কুকুরকে প্রথম রাউন্ড টিকা দেয়া হয়েছে। গাইবান্ধা ও সিরাজগঞ্জ জেলা এবং কক্সবাজার পৌরসভায় কুকুরকে তিন রাউন্ড টিকা দেয়া হয়েছে। ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে সারাদেশেই তিন রাউন্ড টিকা দেওয়া শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
অধ্যাপক ডা. বেনজীর বলেন, ‘কেবল অস্বাভাবিক আচরণ করলেই কুকুর কারও বিরুদ্ধে তেড়ে আসে। কুকুরকে আদর করলে, স্বাভাবিক আচরণ করলে কখনোই কুকুর কামড়ানো তো দূরে থাক, তেড়েও আসবে না।’
শিশুদের বেশি তাড়া করার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘শিশুরা এমনিতেই কুকুর দেখে ভয় পায়। কুকুর দেখেই দৌড় দেয় বলে কুকুর শিশুদেরই বেশি তাড়া করে। আদর সূচক শব্দ করুন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিন, তাহলে কুকুর তাড়া করবে না।’
প্রাইম ব্যাংকের কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, কুকুরের তাড়া খেয়ে তার ছেলেটা এখন আর একা একা স্কুলে যেতে পারছে না। সকালে নামাজ পড়তে গিয়ে কুকুরের তাড়া খেয়ে আর মসজিদে যাওয়া হয় না। প্রায়ই শুনি কুকুরের কামড় খেয়েছে শিশুরা। কুকুর নিধনের মাধ্যমে হোক কিংবা নিয়ন্ত্রণেই হোক, তিনি চান দ্রুত কুকুরের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে।
ইদানীং সংঘবদ্ধ কুকুর দলের চিৎকার, ঝগড়া আর চেঁচামেচিতে অনেকেরই রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে। রাজধানীর সর্বত্রই কুকুরের দৌরাত্ম্য। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় আছেন নিম্নবিত্তরা। টিনশেড বাড়ির বাসিন্দাদের প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে কুকুরের অত্যাচার সহ্য করতে হয়। ঘরের দরজা খোলা থাকলেই সেখানে কুকুর ঢুকে পড়ে। রান্না করা খাবার খেয়ে ফেলে। চলতি পথে মানুষকে কামড়ে দেয়, দলবেঁধে তাড়া করে শিশুদের।
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিউম্যান সোসাইটি ইন্টারন্যাশনাল ঢাকা শহরের কুকুর জরিপ করে। তাদের হিসাবে, দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৩৭ হাজার নয়টি মালিকহীন কুকুর আছে। এর মধ্যে ডিএনসিসি এলাকায় ২৪ হাজার ৩৮৪ ও ডিএসসিসি এলাকায় আছে ১২ হাজার ৬২৫টি কুকুর। এখন এই সংখ্যা আরো বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, কুকুরের কামড়ে বছরে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্ক রোগের আশঙ্কা থাকে। শিশুদের কামড়ালে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই তারা মারা যায়। র্যাবিস ভাইরাসে আক্রান্ত কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, বেজি, বানর বা চিকার মাধ্যমেও জলাতঙ্ক রোগ ছড়ায়। আমাদের দেশে মূলত কুকুরের কামড়ে বা আঁচড়ে (রক্ত বের না হলেও) জলাতঙ্ক রোগ বেশি হয়।
জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি অস্বাভাবিক আচরণ করেন। ক্ষত স্থানে ব্যথা হয়, জ্বালাপোড়া করে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, ঢোক গিলতে গলায় ব্যথা লাগে, জ্বর ও খিঁচুনিও হতে পারে, মুখ দিয়ে লালা ঝরে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, ইচ্ছা থাকলেও পানি পান করতে পারেন না ও পা থেকে শুরু করে পুরো শরীর অবশ হয়ে যেতে পারে। একসময় রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ও মৃত্যু হয়।
ঐক্যবদ্ধ ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের হিসাব থেকে দেখা যায়, ২০০৫ সালে ২৭ হাজার ৬৯১টি, ২০০৬ সালে ৩৭ হাজার ৫১৫টি, ২০০৭ সালে ২০ হাজার ২৭৪টি, ২০০৮ সালে ২২ হাজার ৪০৬টি, ২০০৯ সালে ২৬ হাজার ২৫৬টি ও ২০১০ সালে ২১ হাজার কুকুর নিধন করা হয়েছে। ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৫ হাজার ৭৯৫টি কুকুর নিধন করেছে ডিসিসি।
২০১২ সাল থেকে আদালতের নিষেধাজ্ঞায় কুকুর নিধন বন্ধ হয়ে যায়।