
বেশি মিষ্টি করার জন্য খেজুর গুড়ে মেশানো হচ্ছে কৃত্রিম চিনি। ছবি: সংগৃহীত
খেজুর গুড়ের চাহিদা ঘরে ঘরে। পায়েস হোক বা পিঠাপুলি, মিষ্টি থেকে লাড্ডু- অনেক কিছুতেই গুড়ের অবাধ যাতায়াত। অনেকেই রুটি বা লুচি-পরোটার সঙ্গেও খেজুর গুড় পছন্দ করেন। ফলে ভোজনরসিক বাঙালি প্রায়ই বাজারে খোঁজখবর করেন গুড়ের দরদাম। কিন্তু এই গুড়েও আজকাল মিশছে ভেজাল। বেশি মিষ্টি করার জন্য মেশানো হচ্ছে কৃত্রিম চিনি, কখনো বা রং আকর্ষণীয় করতে মেশানো হচ্ছে কৃত্রিম রংসহ নানা রাসায়নিক।
বাজারে থরে থরে সাজানো চকচকে খেজুর গুড়ের আসল নকল চেনাও কঠিন। ফলে গুড় কিনতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ঠকছেন ভোক্তারা। শুধু তাই নয়, এই ভেজাল গুড় খেয়ে নানা জটিল রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদন পর্যায়ে গুড়ে এসব ক্ষতিকর উপাদান মেশানো হয়। ভেজাল রোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বড় ধরনের হুমকিতে পড়বে জনস্বাস্থ্য। তবে আইনি জটিলতা থাকায় সতর্ক করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)।
শীত এলেই এক শ্রেণির মৌসুমি ব্যবসায়ী ভেজাল খেজুরের গুড়ের ব্যবসায় নামেন। ভেজাল গুড় তুলনামূলক কম দামে বিক্রি করা হয়। না জেনে অনেকে কিনে খাচ্ছেন এসব গুড়। তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রায় সময় অভিযান চালালেও থেমে নেই ভেজাল গুড় তৈরি।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, কারওয়ান বাজারসহ কয়েকটি স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুচরা ব্যবসায়ীরা খেজুর গুড়ের কেজি সর্বনিম্ন ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন। এর মধ্যে প্রতি কেজি খেজুরের পাটালি ১০০ থেকে ২৫০ এবং ঝোলা (তরল) গুড়ের কেজি ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে। ভেজাল আর খাঁটি গুড়ের কারণে পণ্যটির দামে এই বিশাল ফারাক দেখা যায় বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
ক্ষতিকর উপকরণ স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হলেও কেন তারা এগুলো দিয়ে গুড় তৈরি করছেন, জানতে চাইলে আল আমিন নামে মিরপুর ১ নম্বরের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘যা মেশানো হচ্ছে, তা অখাদ্য নয়। আপনারা বাজারে যেসব মিষ্টি কিনে খান, সেগুলোতে এসব রাসায়নিক মেশানো হয়। আবার ফলমূলেও রাসায়নিক মেশানো হয়। গুড়ের রং যাতে সুন্দর হয়, সে জন্য বছরের পর বছর আমরা এভাবে চিনি ও ঝোলা গুড়ের সঙ্গে বিভিন্ন রাসায়নিক মিশিয়ে আসছি। এগুলোর গুণাগুণ সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গুড় ব্যবসায়ী বলেন, ‘এখন আর আগের মতো আখের চাষ নাই। আবার আগের মতো খেজুর রসও পাওয়া যায় না। কারখানার মালিকেরা স্বল্প পরিমাণ খেজুর রস বা আখের রসের সঙ্গে চিনি, ময়দা ও বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে গুড় তৈরি করছে। অনেক সময় কোনটা খাঁটি, কোনটা ভেজাল তা আমরাও বুঝতে পারি না। তবে আমরা চাই দাম বেশি হোক, তবু যেন খাঁটি গুড় তৈরি হয়। ভোক্তারা যেন প্রতারিত না হন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের এক ব্যবসায়ী জানান, রাজশাহীতে যারা গুড় তৈরি করেন, প্রতিবছর তাদের কাছ থেকে কিনে এনে ঢাকায় পাইকারি দরে বিক্রি করেন তিনি।
সেখানে গুড় তৈরির বর্ণনা দিয়ে এই ব্যবসায়ী জানান, গুড়ের চেয়ে চিনির দাম কম। তাই চাষিরা খেজুরের রস জ্বাল করার সময় লালচে বর্ণ ধারণ হলেই তাতে চিনি ঢেলে দেন। প্রতি ১০ লিটার রসে দুই থেকে তিন কেজি চিনি দেওয়া হয়। চিনি গললে হাইড্রোজ ও ফিটকিরি দেওয়া হয়। এসব উপকরণে রস গাঢ় হওয়ার পাশাপাশি গুড়ের রং উজ্জ্বল হয়।
উৎপাদন পর্যায়ে গুড়ে ভেজাল মেশানোর কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে মনে করেন কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী আবির হাসান। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিভিন্ন মানের গুড় আসে ঢাকায়। উৎপাদন পর্যায়ে ভেজাল রোধ করা গেলেই কেবল ভোক্তার জন্য আসল গুড় পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা যাবে। ভেজাল মেশানো এসব গুড় খেয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন ভোক্তারা। পাকস্থলী, খাদ্যনালি, কিডনি, লিভারের ক্ষতিসহ নানা রোগ হতে পারে বলে মনে করে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)।
প্রতিষ্ঠানটির সদস্য (জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি) মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, ক্ষতিকর উপাদান দিয়ে প্রস্তুত করা খেজুরের গুড় স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হতে পারে। বিভিন্ন জেলায় গুড়ের সঙ্গে ভেজাল দেওয়া হয়। এই ভেজাল রোধে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ প্রতিনিয়ত কাজ করছে।
আসল গুড় চেনার উপায় : গুড় আসল না ভেজাল, তা চেনার উপায় আছে। ব্যবসায়ীরা জানান, গুড়ের সঙ্গে চিনি মেশালে দেখতে চকচকে হয়। রসালো থাকে না। রং কিছুটা হলদে বা সাদা হয়ে যায়। আসল খেজুর গুড়ের পাটালি চকচক করে না। বাদামি বা কালচে লাল রঙের হয়। নরম ও রসালো থাকে। এ ছাড়া ভেজাল মেশানো হলে পাটালি খুব শক্ত হয়। আর ঝোলা গুড়ের ক্ষেত্রে নিচের অংশ শক্ত হয়ে যায় এবং তরল অংশ ওপরের দিকে উঠে যায়।