Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে

Icon

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২৩, ১০:২১

বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে

রাজধানী ঢাকা। ছবি: সংগৃহীত

ভূমিকম্প ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে কয়েকটি ফল্টলাইন (ভূচ্যুতি)। এসব ফল্টলাইনে বড় ভূমিকম্প হলেই দেশের অনেক পুরনো ও নরম মাটিতে গড়ে তোলা ভবন ধসে যেতে পারে। সর্বশেষ ১৯১৮ সালে শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়ে যাওয়ার পর বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্প হয়নি বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে।

যদিও অনেক মৃদু মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ১০০ বছরে ভূমিকম্প হওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তি ভূ-অভ্যন্তরে সঞ্চিত হয়েছে, যে কোনো সময় এই শক্তি নির্গত হয়ে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে।

এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান এলাকায় মৃদু মাত্রার ১০০-এর বেশি ভূমিকম্প হয়েছে। আতঙ্ক নয়, ভূমিকম্প হলেও যেন ক্ষয়ক্ষতি কম হয় সেজন্য সরকারিভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি মানুষকে হতে হবে ভূমিকম্প বিষয়ে সচেতন এবং এমন স্থাপনা তৈরি করতে হবে যেন ভূমিকম্পেও টিকে থাকতে পারে। বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব। 

বাংলাদেশের কোথায় ভূমিকম্প হতে পারে

বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই কয়েকটি ফল্টলাইন বা ভূচ্যুতি রয়েছে। এই ফল্টলাইনগুলোতে ভবিষ্যতে ভূমিকম্প হতে পারে। ভূত্বক বা ভূপৃষ্ঠ কয়েকটি বিশাল অথচ খুবই শক্ত পাথর খণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে আছে, এই পাথর খণ্ডকে টেকটোনিক প্লেট বলা হয়। দুটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝে থাকা ফাটলকে বলা হয় ‘ফল্টলাইন’।

ভূ-অভ্যন্তরে দুই টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষ হলে ফল্টলাইন থেকে প্রচুর শক্তি বেরিয়ে আসে এবং তখনই ভূপৃষ্ঠ বিশাল রকমের ঝাঁকুনি খায়, এটাই ভূমিকম্প। ঝাঁকুনি যত বেশি স্থায়ী হবে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা তত বেশি হবে।

তত বেশি মাটির উপরের স্থাপনা, বিশেষ করে ভবনগুলো দুলতে থাকবে এদিক-সেদিক। ভবনের শক্তি কম থাকলে দুলনিতেই ভবন ভেঙে পড়তে পারে অথবা কাত হয়ে পড়ে যেতে পারে অথবা ভবনের তলাগুলো একটার উপর আরেকটা স্যান্ডউইচের মতো চ্যাপ্টা হয়ে যেতে পারে। এমন হলে প্রাণহানির আশঙ্কা থাকবে বেশি।

বাংলাদেশের মূল ভূ-ভাগসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় কম-বেশি ৫টি ফল্টলাইন আছে বলে গবেষকরা বলছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ১৮৯৭ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে একটি ফল্টলাইনে ৮.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। সীমান্ত এলাকায় এরকম আরও ২ থেকে ৩টি ফল্টলাইন আছে।

দেশের ভেতরেও যমুনা সেতুর আশপাশে এবং নোয়াখালী থেকে কক্সবাজার উপকূল পর্যন্ত এরকম আরও একটি ফল্টলাইন আছে। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধুপুরে আরেকটি ফল্টলাইন রয়েছে যার বিস্তৃতি ঢাকার কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত। বাংলাদেশে ১৮৭০ থেকে শুরু করে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত ৭.৫ ও ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এছাড়া ১৭৬২ সালে আরাকান ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল।

অন্যদিকে ১৮৮৫ সালেও আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছিল বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে। ফল্টলাইনে ভূমিকম্প হলে সে ভূমিকম্পের মাত্রা হতে পারে অনেক বেশি। বাংলাদেশে সর্বশেষ ১৯১৮ সালে যে ভূমিকম্প হয়েছিল সিলেট এলাকায়, তার মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার বেশি। তবে ফল্টলাইনের বাইরে ভূমিকম্প হলে এখানে ঝাঁকুনি লাগতে পারে। ক্ষয়ক্ষতি নির্ভর করে ভূমিকম্পের মাত্রা কত বেশি হয়েছে। 

ভূমিকম্প সম্পর্কে কানাডার সাসকাচুয়ান ইউনিভার্সিটির গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বাংলাদেশে সম্ভাব্য ভূমিকম্প সম্বন্ধে বলেন, ‘বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব দিকে বার্মিজ ফল্টে ও উত্তর দিকে সিলেট-মেঘালয় সীমান্তে ডাউকি ফল্টে যে কোনো সময় ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার মতো শক্তি জমা হয়েছে বলে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ভ‚মিকম্প বিজ্ঞানীরা গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছেন।

এই দুই ফল্টের একটিতে ৭ থেকে সাড়ে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হলে অন্য ফল্টেও পরবর্তী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কাছাকাছি মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের ক্ষেত্রে ঘটেছে।

৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক ও সিরিয়ায় সংঘটিত ৭.৮ ও ৭.৫ মাত্রার দুটি বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হয় দুটি ফল্টলাইনে। ৭.৮ মাত্রার ভ‚মিকম্পের কারণে যে ঝাঁকুনি সৃষ্টি হয়েছিল তা প্রবাহিত হয়ে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে অন্য একটি টেকটোনিক প্লেটে ধাক্কা মারে। যার ফলে প্রথম ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার ৯ ঘণ্টা পর তুরস্ক ও সিরিয়ায় দ্বিতীয় ফল্টলাইনে ৭.৫ মাত্রার আরও একটি বড় ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।

একশ বছরে ১০০-এর বেশি ভূমিকম্প বাংলাদেশে

বার্মিজ, ইন্ডিয়ান ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগর খুব কাছে থাকায় বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে সুনামির আশঙ্কাও করেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা। ১৯০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ছোট-বড় ১০০টির বেশি ভূমিকম্প হয়েছে। ৬৫টির বেশি ভূমিকম্প ১৯৬০ সালের পর থেকে রেকর্ড করা হয়। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, যদিও সেগুলো ছোট মাত্রার।

সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে। মূলত উৎপত্তিস্থল থেকে সিলেট অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প প্রবেশ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের অবস্থান ভূমিকম্প জোনে। অতীতের ভূমিকম্পে বাংলাদেশের ভূপ্রাকৃতিক অনেক পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে।

যেমন ১৮৮৫ সালের ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদের মূল স্রোত পরিবর্তন হয়ে নদীটি সরু হয়ে যায়। ব্রহ্মপুত্রের মূল স্রোত যমুনা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তখন থেকে। সিলেটের ডাউকি ফল্ট উৎপত্তিস্থল হলেও ঢাকায় বেশ কিছু ভবনে ফাটল দেখা দেয়। তখন ঢাকায় ৫০০-এর কিছু বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। সিলেটে ইংরেজদের বাংলোগুলো ধসে যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে। 

বাংলাদেশে ভূমিকম্প হলে কী হবে 

প্রশ্ন হলো- বাংলাদেশে ভূমিকম্প হলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির জন্য ব্যবহৃত রানা প্লাজা ধসে যাওয়ার উদাহরণ রয়েছে। রানা প্লাজার মতো এমন দুর্বল ভবনে ভর্তি ঢাকাসহ অন্যান্য শহর। সব ভবন কি বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হয়েছে? সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা বলছেন, বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করা হলে ৯৯ শতাংশ ভবন বড় ধরনের ভূমিকম্পের পরও টিকে যাবে।

তুরস্কের ভূমিকম্পে বেশির ভাগই ৩ থেকে ৬ তলা পর্যন্ত ভবনগুলো ধসে যায়। কিন্তু পাশেই বহুতল ভবনগুলো টিকে গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বহুতল ভবনগুলো বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে নির্মাণ করায় টিকে গেছে প্রমাণ হয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত বাংলাদেশে ভবন নির্মাণে সবচেয়ে বেশি জালিয়াতি হয়ে থাকে বলে বিভিন্ন সময় মিডিয়ায় রিপোর্ট প্রকাশ হয়ে থাকে।

অভিযোগ রয়েছে, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো (যেমন রাজউক) থেকে এক ধরনের নকশা অনুমোদন করে নিয়ে এসে ভবন নির্মাণ করা হয় অন্য আরেক নকশায়। ঢাকা শহরেও এমন উদাহরণ রয়েছে অনেক। ফলে ভবন নির্মাণে যথাযথ নকশা অনুসরণ না করায় সেসব ভবন বড় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

নরম মাটিতে পাইলিং করলেই ভবন মজবুত হয় না

নরম মাটির ঢাকায় প্রচুর বহুতল গড়ে উঠেছে। এই শহরের বিশাল একটি অংশ ভরাট করা হয়েছে বালু ও কাদামাটি দিয়ে। নিচু অথবা জলাশয় বালু দিয়ে ভরাট করে অনেকেই পাইলিং করে ভবন তৈরি করে ফেলছেন। অনেকেই ভাবেন, পাইলিং করে ভবন তৈরি করলেই মজবুত ও ভূমিকম্প সহনীয় হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু পাইলিং করে ভবন তৈরি করলেই ওই ভবন ভূমিকম্প সহনীয় হবে না, আরও কিছু করতে হবে। অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, বর্তমান ঢাকা শহরের যে ৩৫ শতাংশ এলাকার মাটি নরম, বালু দিয়ে ভরাট করে ভবন তৈরি করা হয়েছে। ভবন মজবুত করতে হলে পাইলিং করার সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, যেখানে ভবন উঠবে সেখানকার মাটিকেও শক্ত ও মজবুত করার কাজটি করতে হবে।

ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, নরম মাটিতে পাইলিং করার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ১০ থেকে ১৫ ফুট (মাটি পরীক্ষা করে প্রকৌশলীরা ঠিক করবেন) গভীর পর্যন্ত সিমেন্ট দিয়ে মাটিকে শক্ত করতে হবে। এ রকম করা হলে সেখানে গড়ে ওঠা ভবনটি ভূমিকম্পের প্রবল ঝাঁকুনিও সহ্য করতে পারবে।

কারণ পাইলিং করলে ভবনটি হয়তো শক্ত কলামের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে কিন্তু ভবনের নিচের মাটির নরম হওয়ায় উচ্চ ক্ষমতার ভূমিকম্পে ভবনটি ঝাঁকুনিতে কাত হয়ে যেতে পারে। ভবনের নিচ তলায় সিমেন্টের মজবুত ভিত্তি থাকলে ভবনটিকে ভূমিকম্প বেশি ঝাঁকাতে পারবে না। 

অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ঢাকার ২৫ শতাংশ ভবনই বিল্ডিং কোড না মেনে করা হয়েছে। এই ভবনগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এগুলো যত শিগগির সম্ভব চেক করে রেট্রোফিট করে ভূমিকম্প সহনীয় করে তুলতে হবে এবং এর দায়িত্ব ভবনের মালিককেই নিতে হবে। তারা নিজের উদ্যোগে ভবনগুলো চেক করে সার্টিফিকেট নেবে রাজউক থেকে।

অধ্যাপক আনসারী বলেন, ৫ কাঠার একটি প্লটে তৈরি ভবনগুলোকে চেক করাতে প্রায় ৩ লাখ টাকা ব্যয় হবে। ভবিষ্যতের প্রাণহানি থেকে বসবাসরতদের রক্ষা এবং ভবনটি বিধ্বস্ত হওয়া থেকে বাঁচাতে ৩ লাখ টাকা ব্যয় করাটা খুব বেশি না। ভবনের ভিত্তি সিমেন্ট দিয়ে শক্ত করা ছাড়াও নরম মাটি ভরাট করতে হবে প্রতি ৬ ইঞ্চি পরপর দুরমুজ করে। বন্যাপ্রবণ অথচ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা সব এলাকা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী তার ব্যবহার করতে হবে। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫