-6404d3f04434a.jpg)
রাজধানীর সাইন্স ল্যাব বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত ভবন। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের ব্যবধানে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ এবং কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
এসব বিস্ফোরণ-আগুন নেহাতই দুর্ঘটনা নাকি অন্য কোনও কিছু, সংশ্লিষ্ট কেউ সুনির্দিষ্ট করে তা বলতে পারেননি। তবে ঢাকায় বিস্ফোরণের ঘটনাকে ফায়ার সার্ভিস বলছে ‘সন্দেহজনক’। অন্যদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে লাগা আগুনের পেছনে নাশকতার কথাও কেউ কেউ বলছেন।
প্রথম ঘটনা-সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ
গত শনিবার (৪ মার্চ) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কদমরসুল এলাকায় সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেড নামের প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
খবর পেয়ে কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ ও হতাহতদের উদ্ধারের কাজ শুরু করেন। এ ঘটনায় নিহত হয়েছেন ছয়জন। আর আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২৫ জন।
বিস্ফোরণে পাঁচজনের মৃত্যুর তথ্য সেদিন বিকেলেই নিশ্চিত করেন সীতাকুণ্ড উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহাদৎ হোসেন।
পরে রাতে সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফায়েল আহমেদ জানান, এই বিস্ফোরণে নিহত পাঁচজনের লাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আরেকজনের লাশ ভাটিয়ারির বিএসবিএ হাসপাতালে রয়েছে।
এ ঘটনায় আহত অন্তত ১৯ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ, কীভাবে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে তা জানাতে পারেননি।
সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফায়েল আহমেদ বলেন, বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
তবে যে অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণে ছয়জন নিহত হয়েছেন, সেখানে এক সময় ‘ত্রুটি’ পেয়েছিল কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।
পরিদর্শনে সেই ত্রুটি পাওয়ার পর সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টকে নোটিশও দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মিনা মাসুদ উজ্জামান।
তবে কী ধরনের ত্রুটি ছিল, সে বিষয়ে তিনি এখন কিছু বলতে রাজি হননি। বিষয়টি এখন তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন উদ্দিন দাবি করছেন, কারখানা পরিচালনায় তাদের কোনো গাফিলতি ছিল না।
এই অক্সিজেন প্ল্যান্ট থেকে পৌনে এক কিলোমিটার দূরে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে গত বছরের ৪ জুন রাতে বিস্ফোরণে অন্তত ৫০ জন নিহত ও দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছিলেন।
দ্বিতীয় ঘটনা- সায়েন্সল্যাব এলাকায় বিস্ফোরণ
রবিবার (৫ মার্চ) সকাল ১১টার দিকে রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা সায়েন্স ল্যাবে অবস্থিত প্রিয়াঙ্গন মার্কেটের পাশের একটি বাণিজ্যিক ভবনে হঠাৎই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১৪ জন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সেনাবাহিনীর বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের মেজর মো. কায়সার বারী জানিয়েছেন, তারা কোনও বিস্ফোরকের আলামত পাননি। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, এটি ২০২১ সালের মগবাজারের বিস্ফোরণের মতো ঘটনা। ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে এটি একটি দুর্ঘটনা।
সায়েন্স ল্যাব এলাকার ঘটনার একদিন আগেই শনিবার (৪ মার্চ) সকালে রাজধানীর নিকেতনের ভাড়া বাসায় এসি বিস্ফোরণে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন গোপাল মল্লিক। গুরুতর অবস্থায় তাকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখানে শনিবার মধ্যরাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। একই ঘটনায় মো. মিজান (২০) নামে আরও একজন দগ্ধ হন। তাকে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।
রবিবার (৫ মার্চ) বিকেলে সায়েন্সল্যাব এলাকায় বিস্ফোরণের ঘটনাস্থলের পরিদর্শন শেষে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) বোম ডিসপোজাল ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ও সিটিটিসির বোম ডিসপোজাল দলের প্রধান রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে সায়েন্সল্যাবের বিস্ফোরণের ঘটনাটি ২০২১ সালে ঘটে যাওয়া মগবাজারের বিস্ফোরণের মতো গ্যাস থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরণ। ভবনটিতে কোনও না কোনোভাবে গ্যাস জমে ছিল। জমে থাকা গ্যাসের মাত্রা যদি ৫ থেকে ১১ ঘনফুট হয়, এটা যদি ট্রিগার হয়, তাহলে এ ধরনের বিস্ফোরণ হতে পারে। এটি ট্রিগার সুইচ, ফ্যানের সুইচ বা এসির সুইচের মাধ্যমেও হতে পারে। এটা গ্যাস থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরণ হতে পারে। আর এত বড় বিস্ফোরণ গ্যাস থেকেই হয়ে থাকে।
তৃতীয় ঘটনা-উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ড
রবিবার বিকেলে কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সেখানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দুই হাজারের বেশি ঘর পুড়ে গেছে। এতে করে ঘরছাড়া হয়েছেন প্রায় ১২ হাজার রোহিঙ্গা।
আগুনের সূত্রপাত কীভাবে তা জানা না গেলেও সন্দেহভাজন এক যুবককে আটক করেছে বলে জানিয়েছে ৮ এবিপিএনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ।
জানা যায়, রবিবার বিকেল ৩টার দিকে বালুখালীর ১১ নম্বর ক্যাম্পের বি ব্লকের একটি ঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে আগুন ৯, ১০, ১২ নম্বর ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিসের কক্সবাজার স্টেশনের উপসহকারী পরিচালক অতীশ চাকমা জানান, রোববার সন্ধ্যা ৬টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে আগুনের সূত্রপাতের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। এটি নির্ধারণে সময় লাগবে।
আগুনে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ (সিআইসি) সিনিয়র সহকারী সচিব সরওয়ার কামাল বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দুই হাজার বসতঘর পুড়ে গেছে। এটা আরও বাড়তে পারে। আমরা চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুতের জন্য কাজ করছি।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ পর্যন্ত ২ হাজারের কাছাকাছি ঘর পুড়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিশ্চিত করে বলতে সময় লাগবে। এ পর্যন্ত কোনো হতাহতের তথ্য পাওয়া যায়নি।
ক্যাম্পের এই আগুনকে পরিকল্পিত নাশকতা বলছেন রোহিঙ্গারা। ওই ক্যাম্পের ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আরসার সন্ত্রাসীরা এ আগুন দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের দুটি সশস্ত্র সংগঠন আরসা ও আরএসওয়ের মধ্যে কয়েক দিন ধরে প্রকাশ্যে বিরোধ চলছে, এ ছাড়া গত চার মাসে ১৫টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। একপক্ষ আরেক পক্ষকে ক্যাম্পছাড়া করতে এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গা নেতা কামাল হোসেন গণমাধ্যমে বলেন, কয়েক দিন ধরে আশ্রয়শিবিরে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে গোলাগুলি-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা হতাহত হয়েছেন। এর জেরে একপক্ষ আরেক পক্ষকে উচ্ছেদ করতে শিবিরে আগুন দিতে পারে।

এদিকে গত শুক্রবার (৩ মার্চ) রোহিঙ্গাভিত্তিক ইউটিউব চ্যানেল ‘রোহিঙ্গা রিয়েল ভয়েস’-এ প্রচারিত একটি ভিডিওতে আরসা নেতাকে উদ্ধৃত করে এক রোহিঙ্গার অডিও প্রচার করা হয়। অডিওতে অজ্ঞাতপরিচয় ওই রোহিঙ্গা নিজেকে আরসার সদস্য দাবি করে ক্যাম্পে যারা আরসাকে ‘দমনে’ জড়িত তাদের হুঁশিয়ারি দেন।
বার্তায় আরও বলা হয়, ক্যাম্পে বড় ধরনের ঘটনা ঘটানো হবে, যদি আরসার ওপর ক্ষোভ বন্ধ না হয়। বার্তাটি প্রচারের দুই দিনের মাথায় এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল।
এ বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান গণমাধ্রমে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতা কি না, তা আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। সন্দেহভাজন একজনকে এরই মধ্যে আটক করা হয়েছে। পরিকল্পিত ঘটনা কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
অন্যতিকে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, আমরা অগ্নিদুর্গত রোহিঙ্গাদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে তৎপরতার পাশাপাশি নাশকতা কি না তা খতিয়ে দেখছি।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালে ২২ মার্চ একই ক্যাম্পসহ পার্শ্ববর্তী তিনটি ক্যাম্পে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। সে সময় আগুনে ১০ হাজারেরও বেশি বসতঘর পুড়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা সদস্য গৃহহারা হয়েছিল। এছাড়া দগ্ধ হয়ে দুই শিশুসহ ১৫ জন রোহিঙ্গা মারা যায়।