যেসব কারণে সড়কে যানবাহন চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৩, ১৯:৪৫

মাদারীপুরে দুর্ঘটনা কবলিত ইমাদ পরিবহনের বাস। ছবি: মাদারীপুর প্রতিনিধি
মাদারীপুরের শিবচরে ঢাকা-ভাঙ্গা
এক্সপ্রেসওয়েতে গত রবিবার (১৯ মার্চ) একটি বাস দুর্ঘটনায় অন্তত ১৯ জনের মৃত্যু
হয়েছে, আহত হয়েছে বাসটির প্রায়
সব যাত্রী।
সড়ক পরিবহন নিয়ে কাজ করে, এমন সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বছরের প্রথম তিন মাসেই সারা দেশে অন্তত এক
হাজার সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে,
যার
বড় একটি অংশ হয়েছে বাস, ট্রাক এবং
কাভার্ড ভ্যানগুলোর কারণে।
বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন খাতের সাথে
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরের পর বছর এই
খাতে বেশ কয়েকটি সমস্যা বিরাজমান থাকায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। আইন হলেও
তার শক্ত প্রয়োগ না থাকায় বাস্তব পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি।
দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান
যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সারা দেশে ৬,৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯৯৫১ জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ১২ হাজারের বেশি মানুষ।
সেসব দুর্ঘটনার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা
গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় জড়িত যেসব
যানবাহনের পরিচয় পাওয়া গেছে, তার মধ্যে বাস
রয়েছে ১৪ শতাংশ, ট্রাক ও কাভার্ড
ভ্যান ২৮.৩৯ শতাংশ আর মোটরসাইকেল ২৪.৮০ শতাংশ।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পেছনেও অনেক ক্ষেত্রে
বাস বা ট্রাক বা কাভার্ডভ্যান দায়ী বলে তথ্য রয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, এ বছর গত দুই মাসে সড়কে ১৭৮টি বাস দুর্ঘটনায়
১৮২ জন নিহত আর ৭৪৪ জন আহত হয়েছে। জানুয়ারি মাসে বাস দুর্ঘটনায় ৯৭ জন নিহত আর ৩৬৯
জন আহত হয়েছিল।
বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোয় দুর্ঘটনার পেছনে যেসব
কারণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা-
বেপরোয়া গাড়ি চালানো
বুয়েটের এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের
গবেষণাতে দেখা গেছে, মহাসড়কে যেসব
দুর্ঘটনা ঘটে, তার বড় একটি
কারণ বেপরোয়াভাবে বা অতিরিক্ত গতিতে চালানোর প্রতিযোগিতা। বিপজ্জনকভাবে ওভারটেকিং, চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোন ব্যবহার, মাদক সেবন, চালকের বেপরোয়া মনোভাব- ইত্যাদিকেও দায়ী করা হয়েছে এসব
দুর্ঘটনার জন্য।
মাদারীপুরে যে ইমাদ পরিবহনের যে বাসটি দুর্ঘটনায় পড়ে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, অভিযোগ রয়েছে যে, সেটি নির্ধারিত গতির চেয়ে অনেক বেশি জোরে
চালানো হচ্ছিল।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বুয়েটের
এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক মাহবুবুল আলম তালুকদার বলেন, বাস একটা গণপরিবহন হলেও এটা হয়ে গেছে
প্রাইভেট পরিবহন। এটা উচিত ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা, নজরদারিতে থাকা। কিন্তু এটা ব্যক্তি
মালিকানায় থাকায় সবাই তাদের স্বার্থের বিষয়টি চিন্তা করে।...এ কারণে মালিকরাও
চেষ্টা করে, কত কম খরচ করে, পরিবহন শ্রমিকদের বেশি খাটিয়ে বেশি লাভ করা
যায়। ফলে তারা বাসের মেইনটেন্যান্সের দিকে নজর দেয় না, শ্রমিকদের সুবিধা দেখে না। বেশি লাভ করার
প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে মহাসড়কে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে।...এসব কারণে সড়ক পরিবহন খাত
জুড়ে নানারকম চক্র তৈরি হয়েছে। ফলে এখানে একটা চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। যে যার
মতো করে বাস চালাচ্ছে, সেটার কোন
তদারকি নেই, নিয়ম শৃঙ্খলা
নেই, কারও কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।
এ কারণেই সড়ক জুড়ে দুর্ঘটনা এত বেড়ে চলেছে।
চালকের অতিরিক্ত ট্রিপ
হাইওয়ে পুলিশ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে,
মাদারীপুরের
ইমাদ পরিবহনের বাসটির চালক ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে না ঘুমিয়ে একের পর এক বাসের
ট্রিপ দিয়েছিলেন। ঘুম ঘুম চোখে গাড়ি চালানোর এক পর্যায়ে তিনি নিয়ন্ত্রণ হারান।
নাম না প্রকাশ করা শর্তে একজন বাস চালক জানান, আমাদের নির্দিষ্ট কোন বেতন নাই, প্রতিদিন যতগুলো ট্রিপ দিতে পারবো, সেই হিসাবে আমাদের ইনকাম হবে। তাই অনেকেই
চেষ্টা করে একটু বেশি ট্রিপ দিয়ে বেশি ইনকাম করার।
বাংলাদেশের যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক জানান, চালকরা বেতন না পেয়ে ট্রিপ ভিত্তিক টাকা
পেয়ে থাকেন। এতে করে অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে ভোর বেলা অনেক সময় ঝিমুনি চলে আসতে
পারে। বিশেষ করে চালকের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না করে এরকম ট্রিপ ভিত্তিক করার কারণে
দেশে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে বলে আমরা দেখতে পেয়েছি।
ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন
অভিযোগ উঠেছে যে, মাদারীপুরের
বাসটির ফিটনেস ছিল না। গত নভেম্বর মাসেও এই বাসটি একবার সড়ক দুর্ঘটনায় পড়লেও সেটিই
আবার যাত্রী নিয়ে চলাচল করছিল।
দুর্ঘটনার সময় বাসের একটি টায়ার ফেটে গিয়েছিল বলে তদন্তকারীরা প্রাথমিকভাবে
জানতে পেরেছেন।
বাংলাদেশে অহরহ পুরনো টায়ার বিক্রি করা হয়। বাস মালিকরা বেশি মুনাফা করতে গিয়ে
এসব টায়ার কিনে বাস-ট্রাক চালান,
যা
দুর্ঘটনার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সেই সঙ্গে বাস মালিকদের অতিরিক্ত মুনাফার লোভও এর
জন্য দায়ী। মাদারীপুরের বাসটির আসন সংখ্যা ৪০ হলেও এর অনেক বেশি যাত্রী বহন করা
হচ্ছিল। ফলে বাসটিতে হতাহতের সংখ্যাও বেশি হয়েছে।
নজরদারির অভাব
বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা
বলছেন, দেশের পুরো সড়ক খাতে চরম
বিশৃঙ্খলা রয়েছে। যার সুযোগে ফিটনেস-বিহীন বাস চলছে, অদক্ষ চালকরা গাড়ি চালাচ্ছেন, ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী বহন করা হচ্ছে, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো হচ্ছে। কিন্তু
এক্ষেত্রে কারও কোন নজরদারি নেই।
মাদারীপুরের বাসটির ফিটনেস প্রসঙ্গে বাংলাদেশের
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক বিবিসিকে বলেন, এই বাসটির ফিটনেস ছিল না, রোড পারমিট স্থগিত ছিল, তারপরেও এই যানটি কীভাবে সড়কে যাত্রী নিয়ে
চলছে, সেজন্য বিআরটিএ আর
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত বলে আমরা মনে করি। কারণ এখানে
সরকারের নজরদারি, কর্তৃপক্ষের এবং
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সুস্পষ্ট গাফিলতি ও উদাসীনতা স্পষ্ট দায়ী।
অদক্ষতা
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও বুয়েটের
এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, চালকদের অনেকের সড়কের চিহ্ন এবং আইন কানুন
সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই। এমনকি অনেক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সও থাকে না।
এ্যাসোসিয়েশন অব বাস কোম্পানিজের প্রেসিডেন্ট রফিকুল ইসলাম কাজল বিবিসিকে বলছেন, সমস্যা হলো, আমাদের দেশে চালকের লাইসেন্সে দক্ষতা যাচাই করে দেখা হয় না। টাকা পয়সা দিয়েও অনেকের লাইসেন্স হয়ে যায়। আমি মনে করি, সরকারিভাবে ড্রাইভিং ইন্সটিটিউট করে চালকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হলে তাদের দক্ষতা বাড়তে পারে।