নদী রক্ষা কমিশন শক্তিশালী করতে আইন সংশোধন কতদূর

শাহরিয়ার হোসাইন
প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:১৩

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। ছবি: সংগৃহীত
নদী রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও নদীর দূষণ ও দখল রোধে সুপারিশ করা ছাড়া নদী রক্ষা কমিশনের কোনো কাজ নেই। তাই কমিশনকে শক্তিশালী করার দাবিটি দীর্ঘদিনের। এ বিষয়ে আদালতেরও নির্দেশনা আছে। নদী রক্ষা কমিশনের ক্ষমতা বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা এগোচ্ছে না।
নদীর অবৈধ দখল, পরিবেশ দূষণ, শিল্প কারখানার সৃষ্ট নদী দূষণ, অবৈধ কাঠামো নির্মাণ ও নানাবিধ অনিয়ম রোধ এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার, নদীর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং নৌ-পরিবহনযোগ্য হিসাবে গড়ে তোলাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করা হয়।
‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩’ অনুযায়ী কমিশন পরিচালিত হয়। কিন্তু আইনটিতে কমিশনকে নদী দখল-দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
২০২০ সালে কমিশনকে শক্তিশালী করতে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আর আলোর মুখে দেখেনি। কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আইন সংশোধনে আগের করা সেই খসড়াটি বাতিল হয়ে গেছে। আবার নতুন করে আইনের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছে।
নদীর দখলদারদের অপতৎপরতার কারণে মূলত কমিশনকে শক্তিশালী করা যাচ্ছে না। কমিশনকে ক্ষমতায়িত করার ক্ষেত্রে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নিষ্ক্রিয়তাও অনেকাংশে দায়ী বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কমিশনকে শক্তিশালী করার দাবি
নদী রক্ষার জন্য চলমান যে আইন রয়েছে, তা যথেষ্ট শক্তিশালী না হওয়ার কারণে নদী রক্ষা কার্যক্রম বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বলে গত ১৫ মার্চ বৈঠকের পর জানিয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। একই সঙ্গে সর্বত্র এর যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় এবং আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে নদী দখলকারীরা বেরিয়ে যাচ্ছে। সেই কারণে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের আইনকে আরও শক্তিশালী করা দরকার বলেও সুপারিশ করেছে কমিটি। এছাড়াও কমিটি অতিদ্রুত কমিশনের আইন পরিবর্তন বা সংশোধনের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে।
রয়েছে আদালতের নির্দেশনা
কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আদালত নদী রক্ষা কমিশনকে নদীর অভিভাবক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। উন্নয়নসহ নদী রক্ষায় কমিশন সব কাজ করতে বাধ্য বলেও আদালত আদেশ দিয়েছেন।
২০১৯ সালে হাইকোর্ট আমাদের নদীগুলোকে রক্ষার জন্য ১৭ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। নদী দখল ও দূষণকে ফৌজদারি অপরাধ ঘোষণা করেছেন এবং দখলকারী ও দূষণকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির পরামর্শ দিয়েছেন। সেই সময়ে আদালত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে ক্ষমতায়ন করতে এবং নদী সংক্রান্ত অপরাধে কারাদণ্ড ও মোটা অঙ্কের জরিমানার কঠোর বিধান অন্তর্ভুক্তির জন্য সরকারকে জাতীয় আইন সংশোধনের নির্দেশ দেন।
৩ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি খসড়া আইন
সাবেক সচিব মুজিবুর রহমান হাওলাদার নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান থাকার সময় ২০২০ সালের শেষের দিকে কমিশন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই সময় ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০২০’-এর খসড়া করে কমিশন। খসড়া আইনে ১৪টি অধ্যায়ে ধারা ছিল ১০৮টি। এছাড়া শাস্তি সংক্রান্ত তিনটি তফসিল ছিল। বর্তমান আইনে চারটি অধ্যায়ে ২১টি ধারা রয়েছে।
খসড়া আইনে নদীর দখল ও দূষণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দÐের বিধান রাখা হয়েছিল। ২০১৩ সালের নদী রক্ষা কমিশন আইনের এ ধরনের অপরাধের জন্য কোনো শাস্তি নির্ধারিত ছিল না।
বর্তমান আইন অনুযায়ী, নদীর দূষণ ও দখল রোধে সুপারিশ করা ছাড়া নদী রক্ষা কমিশনের কোনো কাজ নেই। ওই খসড়া আইন অনুযায়ী, কমিশন নদী দখল ও দূষণ রোধ এবং নদীর উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেবে।
এই নির্দেশনা মানতে সংস্থাগুলো বাধ্য থাকবে। সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে কমিশন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। খসড়া আইনে নদী সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য ‘নদী রক্ষা কোর্ট’ গঠনের বিধান রাখা হয়েছিল। খসড়া আইনে কমিশনকে ‘সরকার’ বা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে দায়বদ্ধ থাকার কথা বলা হয়েছিল।
খসড়া নদী রক্ষা কমিশন আইনে বলা হয়, কমিশন নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, অধিদপ্তর ও সংস্থা এবং বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির কার্যাবলি সমন্বয় করবে। এতে আরও বলা হয়েছিল, কমিশন নদী সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো আইন প্রয়োগে নদীর অবৈধ দখলমুক্ত করা এবং পুনঃদখল রোধে এবং উচ্ছেদ ও উদ্ধারে জেলা প্রশাসক ও কালেক্টরসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা, পরামর্শ বা সুপারিশ দেবে। যা তাদের আবশ্যই পালন করতে হবে। বিশেষ ক্ষেত্রে গুরুত্ব বিবেচনায় উচ্ছেদ ও নদ-নদীর ভূমি উদ্ধারে প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়ে অভিযানে নেতৃত্ব দিতে পারবে কমিশন।
যা বলছেন কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান
নতুন কমিশন আইনের খসড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ২০২০ সালের খসড়াটি ছিল সংশোধনী, নতুন আইন নয়। ওই সংশোধনীটা এখন আর কোনো পর্যায়ে বিবেচনাধীন নেই। প্রায় সব মন্ত্রণালয় ও আইন কমিশন ওই খসড়া সংশোধনীটির ব্যাপারে নানাবিধ আপত্তি দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘ওই খসড়াটিতে সন্নিবেশিত অনেকগুলো ধারা আসলে অবাস্তব ও প্রয়োগযোগ্য নয়।
তাছাড়া সংশোধনীটিতে প্রস্তাবিত কয়েকটি ধারা বিদ্যমান কয়েকটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংশোধনীটি অতি দীর্ঘ এবং এতে অনেক অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের অবতারণা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন খসড়াটি প্রত্যাহার করে নেয়। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে, নতুন করে সংশোধনীটি আবার তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো এবং আইন কমিশনে পাঠানো হবে।’
‘সেই লক্ষ্যে কমিশন এ বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটি একটি খসড়া সংশোধনী লেখার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। আশা করি আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এটা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও আইন কমিশনের মতামতের জন্য প্রেরণ করা যাবে।’
চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘কোনো নতুন আইন কিংবা সংশোধনী সংসদে পেশ করার আগের ধাপগুলো একটা সময়সাপেক্ষ কার্যক্রম। তাই কোনোকিছু পেশ করার আগে যথেষ্ট সতর্কতা ও বিবেচনাবোধের প্রয়োজন। না হলে অযথা সময়ক্ষেপণের কারণ হতে পারে।’