Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

মরুভূমির মতো গরম, দায় কার

Icon

জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:০৩

মরুভূমির মতো গরম, দায় কার

প্রতীকী ছবি

টানা ২২ দিন বৃষ্টিহীন ছিল দেশ। তাপ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বৈশাখের উষ্ণতা কোনো বাধাই মানেনি। তাপপ্রবাহ ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। মরুভূমির মতো আবহাওয়ায় বিপর্যস্ত ছিল মানুষ। এমন প্রকৃতিতে ক্ষতির মুখে পড়ে কৃষি। ঝলসে যায় বোরো ধান। ঝরে পড়ে আম ও লিচুর গুটি। খোলা আকাশে কাজ করা শ্রমজীবী মানুষ হয়ে পড়েন কাহিল। গত কয়েক দিন ধরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হালকা বৃষ্টি হলেও কমেনি গরম। বিশেষ করে ঢাকায় তাপমাত্রা কম থাকলেও অনুভব হচ্ছে বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাভূমি ও গাছপালা কমে যাওয়া, বায়ুদূষণ, অপরিকল্পতি নগরায়ণ এবং বৈশ্বিক আবহাওয়ার নানা ধরনের পরিবর্তনের কারণে মরুভূমির মতো তাপ অনুভব হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, এপ্রিল মাসে যে ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে গেল, তাতে আগামী মে মাসে এটা আরও বেশি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও তাপপ্রবাহের দিক বিস্তৃত হওয়ায় ঢাকার মানুষকেও দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সমরেন্দ্র কর্মকার।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা শহরে ছয়টি নদী, শতাধিক খাল ও অসংখ্যা জলাশয় ছিল। ফলে তাপমাত্রা বেশি হলে এখানে অভ্যন্তরীণভাবে জলীয় বাষ্প তৈরি হয়ে মেঘ সৃষ্টি হতো। প্রাকৃতিক উপায়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হতো। কিন্তু সব জলাভূমি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এখন শহরে ভবনের ভেতর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসি ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে তাপমাত্রা কমানো যাচ্ছে না। এসি ব্যবহারের ফলে তাপমাত্রা আরও বাড়ছে।

চলতি বছরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা মহানগরে ২০ ভাগ সবুজ এলাকা থাকা প্রয়োজন, সেখানে আছে সাড়ে ৮ ভাগের কম। সবুজ বা উন্মুক্ত জায়গায় বাণিজ্যিক কার্যক্রমও একটি বাধা।

বিশেষজ্ঞরা ঢাকায় তাপমাত্রা বাড়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি আরও কিছু কারণকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, এসির ব্যবহার বৃদ্ধি, কাচের দালান, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নদী-খাল, জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চল দখল ও ভরাট, খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান দখল, মহানগরের চারপাশের নদীদূষণ, ভূগর্ভস্থ পানির অপরিকল্পিত উত্তোলন ও বায়ুদূষণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের মনিটরিংয়ে দেখা যায়, গত ১০০ বছরে দেশের তাপমাত্রা ০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বাড়লেও ঢাকায় বেড়েছে ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালে ঢাকা শহরের ৬৫ শতাংশ কংক্রিট বা অবকাঠামোতে আচ্ছাদিত ছিল। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় প্রায় ৮২ শতাংশ। এই সময়ে জলাশয় ও খোলা জায়গা প্রায় ১৪ শতাংশ থেকে কমে ৫ শতাংশের নিচে নেমেছে। যে কারণে ঢাকার তাপমাত্রা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি থাকছে।

এই যে খোলা জায়গা ভরাট হয়েছে, সে জন্য কাউকে শাস্তি পেতে হয়েছে, এমন উদাহরণ নেই বললেই চলে। বরং সরকারি সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগ। সম্প্রতি ঢাকার কল্যাণপুরের রেগুলেটিং পন্ডের কাছের ১১ একর নিচু জমি ভরাট করে গবেষণাগার তৈরির কাজ শুরু করেছে সরকারি সংস্থা বিএডিসি। ঢাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ওই নিচু জমিটি ড্যাপে জলাধার হিসেবে দেখানো হয়েছে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ করতে বনানীর কাকলী থেকে-বনানী রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের পশ্চিম পাশের জলাধার, কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিমানবন্দর সড়ক এবং রেললাইনের মাঝখানের জলাধার ভরাট হয়েছে। কুড়িল ফ্লাইওভার নির্মাণের সময়ও ভরাট করা হয়েছে জলাধার। তবে সেখানে একটি লেক রাখা হয়েছে। কুড়িল বিশ্বরোড-জোয়ারসাহারার মাঝখানের নিচু জমি ভরাট করে পূর্বাচল প্রকল্পের একটি সাইট অফিস করা হয়েছে। উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টর এলাকাটিও একসময় বিস্তীর্ণ জলাধার ছিল।

খিলক্ষেতের পুলিশ অফিসার্স হাউজিং, আশিয়ান সিটি, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ৩০০ ফুট সড়ক তৈরিতেও ভরাট হয়েছে জলাভূমি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আমিন বাজার ল্যান্ডফিল, একই এলাকায় মধুমতি মডেল টাউন ও আমিনবাজার জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রও করা হয়েছে জলাভূমি ভরাট করে। বনশ্রী, আফতাবনগর, সাঁতারকুল এবং ঢাকার পশ্চিমে মোহাম্মদপুরের বছিলা এবং আশেপাশের এলাকাও গড়ে তোলা হয়েছে নিচু এলাকা ভরাট করে।

নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, সরকারি বিভিন্ন পরিকল্পনায় আছে জলাধার রাখতে হবে, সবুজ এলাকা রাখতে হবে। কিন্তু তারা নিজেরাও রাখতে পারছে না এবং বেসরকারি পর্যায়ে যেসব আবাসন হচ্ছে তাদেরকেও মানাতে পারছে না। এটা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা। ব্যবসায়ীদের মুনাফার লোভ, ব্যক্তি পর্যায়ে আইন না মানা, সবুজ এলাকা, খোলা জায়গা না থাকার প্রবণতা মারাত্মক। এজন্য সরকারের পাশাপাশি বিশিষ্ট নাগরিকদেরও দায়ী করা যায়, তারা বিষয়টি নিয়ে তেমন কথা বলে না।

ছাদ বাগানে উৎসাহী করতে ১০ শতাংশ কর ছাড়ের ঘোষণা আছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের। অথচ এই সংস্থার বিরুদ্ধেই আছে বৃক্ষ রক্ষায় উদাসীনতার অভিযোগ। মহাখালী থেকে গুলশান-১ নম্বর পর্যন্ত সড়ক, নর্দমা ও ফুটপাত উন্নয়নকাজে সড়কজুড়ে সড়ক বিভাজক উঁচু করা হচ্ছে দেয়াল দিয়ে। এজন্য মহাখালী থেকে গুলশান পর্যন্ত বিভাজকের বিভিন্ন জায়গায় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। অনেক জায়গায় শেকড় কেটে ফেলায় গাছগুলো মরে যাচ্ছে।

২০১৭ সালে গুলশান শুটিং ক্লাব থেকে লেক পার্ক পর্যন্ত গুলশান অ্যাভিনিউ সড়ক বিভাজকের গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছিল। শেকড় কেটে ফেলায় মারা পড়েছিল আরও কিছু গাছ।
ওই বছরই উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরে সড়ক ও ফুটপাত উন্নয়নকাজ চালাতে গিয়ে সড়কের পাশাপাশি ফুটপাতের গাছও কেটে ফেলা হয়।

গত জানুয়ারিতে ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডে সড়ক বিভাজকের গাছ কেটে ফেলা হয়। মহাখালী থেকে বনানী সড়কের পাশের সবুজ বেষ্টনীর গাছপালা কেটে মহাখালীতে করা হয়েছে অস্থায়ী বাজার। সেতু ভবন, বিআরটিএ ভবন, সড়ক ও জনপথের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় করতে গিয়েও কাটা হয়েছে গাছ। বিমানবন্দর সড়ক ধরে বনানীর কাকলী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কের দুপাশের গাছপালা কেটে ‘সৌন্দর্যবর্ধন’ করা হয়েছে।

মেট্রোরেলের জন্য বেগম রোকেয়া সরণির সড়ক বিভাজক এবং দুপাশের গাছ, সড়ক উন্নয়ন কাজের জন্য আগারগাঁও থেকে শ্যামলী শিশু মেলা পর্যন্ত সড়কের বিভাজকের গাছও কেটে ফেলা হয়েছে। বিআরটি প্রকল্পের জন্য উত্তরায় কাটা হয়েছে গাছ।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫