Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

মালয়েশিয়ায় শ্রম রপ্তানি

সিন্ডিকেটে হাওয়া বদল

Icon

প্রতীক সিফাত

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৩, ১০:৩২

সিন্ডিকেটে হাওয়া বদল

সিন্ডিকেটের কারণে চাহিদার চেয়ে শ্রমিক রপ্তানিতে বেশ পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। ছবি: সংগৃহীত

মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার চালুর আগে থেকেই দেশের ২৫ এজেন্সির বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট তৈরির অভিযোগ উঠেছিল। সবার জন্য শ্রমবাজার উন্মুক্ত রাখার দাবিতে তাদের বিরুদ্ধে একাধিক ব্যানারে আন্দোলন করেন এজেন্সি মালিকরা, যার নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক সভাপতি মোহা. নূর আলী। 

মালয়েশিয়ায় শ্রম রপ্তানিতে পুরনো ১০ সিন্ডিকেটের প্রধান বলা হয় থাকে তাকে। এর মধ্যে গত ৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বায়রার নির্বাচনে তার সমর্থিত প্যানেল বিজয়ী হয়। সিন্ডিকেট ভেঙে উন্মুক্তভাবে কর্মী রপ্তানির ইশতেহারের সুবাদে জয় পায় মোহাম্মদ আবুল বাশার ও শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান। তাদের ‘বায়রা সম্মিলিত ঐক্য পরিষদ’ প্যানেল রুহুল আমিন স্বপনের নেতৃত্বাধীন নতুন সিন্ডিকেটকে হারিয়ে নির্বাহী কমিটির ২৭টি পদের ২৩টিই দখলে নেয়। 

এদিকে নির্বাচনের ছয় মাস পেরুলেও বায়রার ১ হাজার ৭৭১ সদস্য বা এজেন্সির জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হয়নি প্রবাসী আয়ের অন্যতম বৃহৎ দেশটির শ্রমবাজার। বরং সংগঠনের সভাপতি আবুল বাশার ভিড়েছেন রুহুল আমিন স্বপনের দলে। উপদেষ্টা পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে মোহা. নূর আলীকে। এ ক্ষোভে নূর আলী গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ চৌধুরী ও অর্থ সম্পাদক পদত্যাগ করলেও তা গ্রহণ না করে উল্টো তাদের সংগঠন থেকে অপসারণ করেছেন তাদের প্যানেলেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাহী সদস্যরা।

নতুন সিন্ডেকেটের ভেতরে ও বাইরের একাধিক জনশক্তি রপ্তানিকারক জানান, এ বছরের শুরুতে মালয়েশিয়ায় গিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করেন মোহা. নূর আলী ও বায়রা সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান। বাংলাদেশের শ্রমবাজারে সিন্ডিকেট তৈরিতে মালয়েশিয়ার আগের সরকারের মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। পাশাপাশি বাজার উন্মুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা চান। এরপর দেশে ফিরে তারা গত ২ ফেব্রুয়ারি এক সভার আয়োজন করেন, যেখানে একপর্যায়ে হট্টগোল থেকে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে বায়রা থেকে তাদের অপসারণ করা হয়। 

বায়রার নেতারা বলেন, শ্রমিক পাঠাতে মালয়েশিয়ার বিদায়ী সরকারকে কয়েকশ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছে ২৫ জনের নতুন সিন্ডিকেট। সে কারণেই তারা গেল বছর দেশটিতে কর্মী পাঠিয়েছেন। সিন্ডিকেটটি এ বছরও আগের নিয়মেই শ্রমিক পাঠাচ্ছে। ক্ষমতায় আসা আনোয়ার ইব্রাহিমের সরকার শ্রমবাজার উন্মুক্ত করবে কিনা, তার নিশ্চয়তা নেই। তাই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে নূর আলী গ্রুপের নেতারা এখন ভিড়ছেন রুহুল আমিন স্বপনের সিন্ডিকেটে। বায়রার সাবেক সভাপতি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য বেনজীর আহমদও ইতোমধ্যে নূর আলীর গ্রুপ ছেড়ে নতুন সিন্ডিকেটে নাম লিখিয়েছেন। এতে আছেন ফেনীর সংসদ সদস্য মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, নিজাম উদ্দিন হাজারীসহ প্রভাবশালী আরও বেশ কয়েকজন। এ অবস্থায় মালয়েশিয়ার বর্তমান সরকার এবং বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় চাইলেও সিন্ডিকেট ভাঙার বিষয়ে যথেষ্ট সন্দিহান বায়রা সদস্যরা। 

জানতে চাইলে বায়রা সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, ‘আমিও চাচ্ছি মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার উন্মুক্ত হোক। এখানে কোনো সিন্ডিকেট নেই। মালয়েশিয়া সরকারের তালিকা অনুযায়ী যে যার মতো কর্মী পাঠাচ্ছে। সদস্য এবং বাংলাদেশি কর্মীদের কল্যাণে বায়রা সেভাবেই কাজ করছে।’ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা আগের ঘটনা। আমি ছিলাম না। সেখানে কী কথা হয়েছে তাও জানি না।’

শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান অবশ্য বলেন, ‘আবুল বাশার সাহেব সিন্ডিকেটের পেছনে চলে গেছেন। তিনি ভোটারদের সঙ্গে দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভেঙে নিজে লাভবান হচ্ছেন। তার মতো অনেকেই সিন্ডিকেটে চলে গেছে। আমি বায়রা সদস্যদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে গিয়ে পদত্যাগ করেছি। কিন্তু পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে আমাকে অপসারণ করেছেন, এটা আইনসিদ্ধ নয়। বর্তমানে যাকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এটাও অবৈধ।’

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা গোপন কিছু না, তখন সভাপতিরও থাকার কথা ছিল। কিন্তু পাসপোর্ট জটিলতায় তিনি আটকে যান। দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট বলেছেন, তিনি বা তার সরকার সিন্ডিকেট রাখবে না। এ জন্য তিনি শ্রমবাজারকে ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করেছেন। আমাদের সরকারও চাচ্ছে সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে।’

বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় একজন কর্মী বা শ্রমিক পাঠাতে সর্বোচ্চ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করেছে সরকার। নিয়ম অনুযায়ী, উড়োজাহাজ ভাড়া, স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ আনুষঙ্গিক সব ব্যয় নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বহন করবে। কিন্তু বাস্তবে সেই ব্যয়ের পাঁচ গুণ আদায় করছে জনশক্তি রপ্তানির দায়িত্বে থাকা এজেন্সিগুলো। এতে ঋণের বোঝা নিয়ে বিদেশ যাওয়া শ্রমিককে খরচের টাকা তুলতেই এক বছর লেগে যাচ্ছে। 

কাকরাইলের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে সম্প্রতি ভিসা প্রসেসিংয়ের জন্য এসেছিলেন বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের স্নাতক তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের ১১ শিক্ষার্থী। তাদেরই একজন কাওসার আলী। ইতিহাস চতুর্থ বর্ষের এ ছাত্র জানান, জেলা শহরের সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) থেকে ইলেকট্রনিক্স ট্রেডের ওপর কোর্স করেছেন তারা। মালয়েশিয়ায় যেতে স্থানীয় দালালের মাধ্যমে ঢাকার ‘সাউথপয়েন্ট ওভারসিজ’ এজেন্সির সঙ্গে সাড়ে ৩ লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। মাসে তাদের দেড় হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (প্রায় ৩৫ হাজার টাকা) বেতনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। 

ঢাকার ডেমরা এলাকার বাসিন্দা আরিফ হোসেন বলেন, বনানীর ‘ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল’ এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় শ্রমিকের ভিসা পেয়েছেন তিনি। এ জন্য তাকে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আলাদা করে ক্যাথারসিসের মেডিক্যাল সেন্টারকে দিতে হয়েছে সাড়ে ১০ হাজার টাকা। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. রুহুল আমিন স্বপন। অভিযোগ রয়েছে, মালয়েশিয়া সরকার নির্ধারিত এজেন্সিগুলোর বর্তমান সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন তিনি। জানতে চাইলে রুহুল আমিন (স্বপন) বলেন, ‘মানুষের মধ্যে একটা পারসেপশন আছে যে, আমরা টাকা বেশি নিই। আসলে সরকার নির্ধারিত ফি-ই নিচ্ছি আমরা।’

অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত ব্যয়ের বাইরে আদায়কৃত অতিরিক্ত অর্থের একটা অংশ বুকিংমানি হিসেবে আগেভাগেই মালয়েশিয়ার রাজনীতিবিদ-প্রশাসনের কাছে অবৈধপথে পাঠানো হয়। একইভাবে সিন্ডিকেটের প্রদর্শিত আয়ের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ পাচার হচ্ছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্কটেরও কারণ।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরীফুল হাসান এ বিষয়ে বলেন, ‘সিন্ডিকেটের কারণে দুইভাবে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক. প্রবাসীদের আয়ের অর্থ থেকে ওই দেশে (মালয়েশিয়া) ঘুষ দেওয়ার টাকা পরিশোধ করা হয়। দ্বিতীয়ত দুর্নীতিবাজরা এই কালো টাকা বিদেশে পাচার করছে হুন্ডির মাধ্যমে। তবে বর্তমান আনোয়ার ইব্রাহিম সরকার ক্ষমতায় এসেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছেন। তার বাস্তবতা ঘটলে এবং দুই দেশের সিন্ডিকেট ভাঙলে মালয়েশিয়ায় অভিবাসন ব্যয় অর্ধেকের নিচে নেমে আসবে।’ 

পুরানা পল্টনের একজন সাব-এজেন্ট বলেন, একেকজনের ভিসা প্রসেসিং ফি হিসেবে মালয়েশিয়ার এজেন্সিকে ৬ হাজার রিঙ্গিত বা প্রায় ১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা দিতে হয়। উড়োজাহাজ ভাড়া ৬৫ হাজার, স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ১০ হাজার আর বাংলাদেশে সিন্ডিকেট নিচ্ছে জনপ্রতি ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা করে। এর বাইরে মধ্যস্বত্বভোগী দালাল, সাব-এজেন্টদের ফি তো রয়েছেই। 

দেশের ১০ সিন্ডিকেটের নৈরাজ্যের কারণে ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল-এ তিন বছর মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রপ্তানি বন্ধ ছিল। নানা আলোচনা ও দেনদরবারের মাধ্যমে গত বছরের জুনে বাজারটি আবারও উন্মুক্ত হয়। মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী দাতুক সেরি এম সারাভানান ওই সময়ে ঢাকায় এসে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি জানান, প্রথম বছরে তারা ২ লাখ শ্রমিক নেবে। পাঁচ বছরের টার্গেট পাঁচ লাখ। তবে সিন্ডিকেটের কারণে চাহিদার চেয়ে শ্রমিক রপ্তানিতে বেশ পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় শ্রমিক ভিসায় ১ লাখ ৩২ হাজার ৯৮৩ জন দেশ ত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২৪ হাজার ৯৯৪, ফেব্রæয়ারিতে ২৯ হাজার ৩২০ ও মার্চে ২৮ হাজার ৫৭৯ জন। আর গেল বছর গেছেন ৫০ হাজার ৯০ বাংলাদেশি শ্রমিক।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫