Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার অনুপস্থিতি

ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা ব্যবস্থা

Icon

রাইয়্যিদাল কবির

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৩, ১৩:২৮

ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা ব্যবস্থা

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অস্বস্তি। ছবি: সংগৃহীত

সরকারি হাসপাতালে এখনো ডাক্তার অনুপস্থিতি ব্যাহত করছে চিকিৎসা ব্যবস্থা। ‘বিশ্বব্যাংকের পোভার্টি অ্যান্ড শেয়ার প্রসপারিটি ২০২০’-এর তথ্য অনুসারে দেশে ২ কোটি ২৯ লাখ মানুষ অতি গরিব বা হতদরিদ্র। বিশাল সংখ্যক এই মানুষ দিনে ১.৯০ মার্কিন ডলারের (প্রায় ২০৩ টাকা) কম আয় করে থাকে বলে বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়েছে। এই হতদরিদ্র মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল সরকারি হাসপাতাল।

শুধু হতদরিদ্র নয়, নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষও চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালেই যায়। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের উপস্থিতি কম থাকলে এই বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা ব্যাহত হয়ে থাকে। তাছাড়া বিলম্বিত চিকিৎসার কারণে মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ও বেড়ে যায়, সঙ্গে ভোগান্তিও বাড়ে। রোগও তখন জটিল হয়ে পড়ে।

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অস্বস্তি তো রয়েছেই। এটা নিয়ে জাতীয় সংসদে এবং সংসদীয় কমিটিতেও ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা হওয়া সত্তে¡ও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, আগের মতোই রয়ে গেছে। যদিও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা তা স্বীকারই করতে চান না। 

২০২২ সালে প্রকাশিত স্বাস্থ্য বুলেটিন ২০২০ অনুযায়ী, এখন সাধারণ মানুষ যেন স্বাস্থ্য বিষয়ে মতামত প্রদান করতে পারেন সে উদ্দেশ্যে মোবাইল ফোনে এসএমএসের (খুদে বার্তা) মাধ্যমে তাদের মতামত প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখা এসব এসএমএস গ্রহণ করে থাকে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ৭৩৯টি সরকারি হাসপাতাল ও সংস্থাকে যুক্ত করা হয়েছে এই ব্যবস্থায়।

এসএমএস করে সেবাগ্রহীতারা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের অর্থাৎ চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির ব্যাপারেই বেশি অভিযোগ করেছেন। স্বাস্থ্য বুলেটিন ২০২০ অনুযায়ী, ২০১৪-২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট ২৪ হাজার অভিযোগ, পরামর্শ ও ইতিবাচক মন্তব্য গ্রহণ করেছে এমআইএস। এর মধ্যে ৩২ শতাংশ এসএমএসই চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের অনুপস্থিতির ব্যাপারে অভিযোগ করা হয়েছে।

প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে, ‘সেবাগ্রহীতরা চিকিৎসকের নাগাল পাচ্ছে না, তারা কর্মক্ষেত্রে নেই বা অনুপস্থিত’ এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল থেকে সাধারণ মানুষই ঢাকায় সংশ্লিষ্টদের পাঠাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে, চিকিৎসকদের ডিজিটাল টাইম অ্যাটেনডেন্স বা ডিজিটাল হাজিরা থেকে জানা গেছে, গত ৮ মে সারাদেশে ১৫ হাজার ২৪৪ জন চিকিৎসক অনুপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন ৩৪ হাজার ৩২০ চিকিৎসক।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওই ডিজিটাল উপস্থিতি শিটে অনুপস্থিতদের ব্যাপারে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘কিছু স্টাফ (চিকিৎসক) রোস্টার ডিউটি করে থাকেন। তারা পরের পালায় উপস্থিত থাকবেন।’ এ ব্যাখ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বুঝিয়েছে যে, ‘দিনের বেলা যারা উপস্থিত ছিলেন না তারা হয়তো রাতের ডিউটিতে উপস্থিত থাকবেন।’ 

গত ৮ মে দেশে মোট ৩৪ হাজার ৩২০ জন চিকিৎসক সরকারি হাসপাতালে উপস্থিত থাকলেও বিভাগওয়ারি উপস্থিতির হার কম। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ৮ মে চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৫.৬২ শতাংশ। অর্থাৎ চট্টগ্রাম বিভাগে চিকিৎসক অনুপস্থিত ছিলেন ১৪.৩৮ শতাংশ। এরপর খুলনা বিভাগে ৬২.৯৪ শতাংশ চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন। এরপর পর্যায়ক্রমে চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন যথাক্রমে ময়মনসিংহ বিভাগে ৭৬.৪৮ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ৭৪.৫৩ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে ৭১.৫৭ শতাংশ, সিলেট বিভাগে ৭০.৪৯ শতাংশ, রংপুর বিভাগে ৬৭.৫৯ শতাংশ এবং ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে কম উপস্থিতি ছিল চিকিৎসকরা। ৮ মে ঢাকা বিভাগে চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন ৬৩.৬৯ শতাংশ। এছাড়া সম্মিলিতভাবে ৮ মে চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন ৭১.৯৯ শতাংশ এবং অনুপস্থিত ছিলেন ২৮.০১ শতাংশ। 

জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক এ ব্যাপারে বলেন, ‘চিকিৎসক অনুপস্থিতি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে। আমাদের দেশে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যায় সাধারণত দরিদ্র মানুষ। চিকিৎসক যথাসময়ে না থাকলে চিকিৎসা বিলম্বিতও হয়। আর কোনো কোনো রোগ আছে, বিলম্বের কারণে তার প্রকোপ বাড়ে। রোগের সূচনাতেই ডায়াগনসিস (পরীক্ষা করে সঠিক রোগটি শনাক্ত করা) করে চিকিৎসা শুরু করতে পারলে খুব কম খরচে এবং অল্প ওষুধে রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

কিন্তু চিকিৎসা দেরি করলে মানুষের ভোগান্তি যেমন বাড়ে আবার খরচও বেড়ে যায়। অনেক সময় তখন আর উপজেলা অথবা জেলা সদরের হাসপাতালে চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না, রোগীকে যেতে হয় মেডিক্যাল কলেজ (টার্শিয়ারি) হাসপাতালে অথবা অন্য কোনো উচ্চ শিক্ষা হাসপাতালে। রোগীর সঙ্গে রোগীর স্বজনদের নিয়ে যেতে অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়।’ অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখলে দেশের চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা তথা স্বাস্থ্যোন্নয়ন ঘটবে।’


জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ থাকার পরও শুধু চিকিৎসকের অনুপস্থিতি সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউএইচসি) অর্জনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানী ও বিভাগীয় শহরের বাইরে জেলা-উপজেলায় সরকারি চিকিৎসকের অনুপস্থিতির হার তুলনামূলক বেশি। দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো অনুপস্থিতির বিষয়টিকে প্রভাবিত করছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্থানীয় দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও কাজের অতিরিক্ত চাপ, কর্মজীবনের অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা চিকিৎসকের অনুপস্থিত থাকার বিষয়কে প্রভাবিত করে।

স্বাস্থ্য আিধদপ্তরের ডিজিটাল টাইম অ্যাটেনডেন্স শিট অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগেই সবচেয়ে কম চিকিৎসক উপস্থিতি ছিল। শুধু রাজধানীতেই প্রায় ২ কোটি মানুষ বাস করেন। এর মধ্যে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী দরিদ্র, হতদরিদ্র এবং এদের প্রায় সবাই বস্তির মতো ঘিঞ্জি এলাকায় বসবাস করে। শহরে বাস করেও এরা শহরের সুযোগ-সুবিধাগুলো ভোগ করতে পারে না। ফলে অপুষ্টির শিকার হয়ে নানা ধরনের রোগে ভোগে সারা বছর।

যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন ও বাংলাদেশের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ ‘হোয়্যার আর দ্য ডক্টরস? এ স্টাডি অ্যাবসেনটিজম অ্যামাং ডক্টর ইন রুরাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতি দুর্নীতির একটি সাধারণ রূপ। এর প্রধান কারণ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় কর্মীর ঘাটতি ও অন্যান্য চিকিৎসা উপকরণের সংকট। দেশে চিকিৎসকের অনুপস্থিতির হার ৩৫ শতাংশ। 

গবেষণায় ছয়টি কারণে চিকিৎসকের অনুপস্থিতি প্রভাবিত হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কর্মক্ষেত্রের অনুপযুক্ত পরিবেশ, অনুপযুক্ত স্বাস্থ্য অবকাঠামো, যানবাহন না থাকা, চিকিৎসকের নিরাপত্তার অভাব, অতিরিক্ত কাজের চাপ ও উপকরণের অপর্যাপ্ততা। পাশাপাশি রয়েছে পেশাগত উৎকর্ষের জন্য উচ্চতর ডিগ্রিতে প্রস্তুতি সুবিধার অভাব, পদোন্নতি ও বদলির জটিলতা। এছাড়া রয়েছে, ‘লিঙ্গবৈষম্য, সেবাগ্রহীতার সঙ্গে সেবাদাতার সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়ার জটিলতা, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা, শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা ও ব্যবস্থাপনার অভাব’।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চিকিৎসকরা অভিনব পন্থায় হাসপাতালে অনুপস্থিত থেকেও উপস্থিত থাকেন। হাসপাতালে তারা দীর্ঘ সময় না থাকলেও খাতা কলমে তাদের উপস্থিতি বজায় থাকে। এই ব্যাপারটি সবাই জানেন এবং ঊর্ধ্বতন চিকিৎসকদের অনুমোদনক্রমেই ঘটে থাকে কিন্তু কেউ এ নিয়ে মুখ খোলেন না। মাঝে মাঝে দেখা গেছে, মন্ত্রীদের কাছে অনুপস্থিত চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি ধরা পড়লে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করতে। 

সাধারণ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তারা নিজেদের জন্য একান্তে কাজ করতে অথবা পারিবারিকভাবে সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে চিকিৎসকদের নিজেদের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা হয়। এই সমঝোতার মাধ্যমেই একজন চিকিৎসক বিরতিহীনভাবে ২৪ ঘণ্টা অথবা ৪৮ ঘণ্টা ডিউটি করে থাকে হাসপাতালে। স্বাভাবিকভাবে একজন চিকিৎসক এক ঘণ্টা বিরতিসহ ৮ ঘণ্টা ডিউটি করেন। কেউ বিরতিহীনভাবে ৪৮ ঘণ্টা ডিউটি করেন সমঝোতা অনুযায়ী ধরে নেওয়া হয়, সেই চিকিৎসক ৬ দিন (৬×৮=৪৮ ঘণ্টা) ডিউটি করেছেন।

সমঝোতা অনুযায়ী তিনি ২ দিনে ৬ দিনের ডিউটি শেষ করে বাকি ৪ দিন নিজের কাজে চলে যেতে পারেন। এই সমঝোতার মাধ্যমে ডিউটি করে হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকাকালে কোনো মন্ত্রী এসে সেই ডাক্তারকে না পেলে তাকে বরখাস্ত করার ঘটনা ঘটেছে অতীতে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা কাগজে-কলমে ডাক্তারের উপস্থিতি ধরে নিয়ে তার বরখাস্তের আদেশ বাতিল করে দেন। এভাবে অনেক চিকিৎসক হাসপাতালে অনুপস্থিত থেকেও উপস্থিত থেকে চাকরি চালিয়ে যেতে পারছেন। 

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, ‘এ ধরনের কর্মকান্ডকে অনুমোদন করা মোটেও উচিত নয়। ব্যাপারটা যদি এমনই ঘটে, তাহলে এসব বন্ধ করতে হবে। এসব অনুমোদন করলে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই একদিন ভেঙে পড়বে।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫