
মহাখালী থেকে গুলশান পর্যন্ত বিভাজকের বিভিন্ন জায়গায় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি ঢাকার কল্যাণপুরের রেগুলেটিং পন্ডের কাছের ১১ একর নিচু জমি ভরাট করে গবেষণাগার তৈরি শুরু করেছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। ঢাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ওই নিচু জমিটি ড্যাপে জলাধার হিসেবে দেখানো হয়েছে।
কক্সবাজারের দরিয়ানগরে ছিল ঘন জঙ্গল। সরকারের তালিকার সংরক্ষিত বন। এ বনেরই পাঁচ একর জমি চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স ইউনিভার্সিটিকে বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। সেখানে গাছপালা কেটে স্থাপনা নির্মাণ করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। যে এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়কে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেটি বিপন্ন এশীয় হাতি, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, বন্য কুকুর ও বানরের আবাসস্থল।
এভাবে রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বনভূমি ও জলাশয়সহ প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে। আর এর জন্য প্রভাবশালীদের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানও দায়ী। ফলে দেশে প্রতিদিন কমছে সবুজ। বাড়ছে দালানকোঠা, রাস্তাঘাট ও বসতি। কোথাও আবার গাছ কেটে পাচার করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও বনের ভেতরেই ইটভাটার চুল্লিতে জ্বলে কাঠ। বন ও জলাশয় ধ্বংসের ঘটনায় মামলা ও আদালতের রায় মানা হচ্ছে না।
সারাদেশে বন ধ্বংস
দেশে বনভূমি কমে যাওয়ার তথ্য ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর প্রকাশ করে বন অধিদপ্তর। তাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট বনভ‚মির পরিমাণ ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ একর। এর মধ্যে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৪৫২ একর বনভূমি বেদখল হয়ে আছে বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে। সবচেয়ে বেশি বনভূমি বেদখল হয়েছে কক্সবাজার জেলায়। জেলাটিতে ৫৯ হাজার ৪৭১ একর বনভূমি বেহাত হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অধিদপ্তর কর্তৃক সর্বশেষ পাঁচ বছরে মাত্র আট হাজার ৭৯২ একর (৩%) উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে উন্নয়নকাজের নামে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে বন মন্ত্রণালয়। বড় বরাদ্দ নিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা), বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফআইডিসি), গ্যাসক্ষেত্র ও সড়ক কর্তৃপক্ষ। রোহিঙ্গাদের বসতির কারণে ধ্বংস হওয়া বনভূমি এ হিসাবের বাইরে।
বৃক্ষ রোপণে প্রণোদনা, গাছও কাটছে
রাজধানীর ধানমন্ডির পিলখানা থেকে ২৭ নম্বর পর্যন্ত গত জানুয়ারি থেকে সড়ক বিভাজক নির্মাণের কারণে কাটা পড়েছে ৬০০ গাছ। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গত ১৫ দিন ধরে আন্দোলন করছেন পরিবেশবিদরা। কিন্তু তাতেও গাছ কাটা থামায়নি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
ছাদ বাগানে উৎসাহী করতে ১০ শতাংশ কর ছাড়ের ঘোষণা আছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের। অথচ এই সংস্থার বিরুদ্ধেই আছে বৃক্ষ রক্ষায় উদাসীনতার অভিযোগ। মহাখালী থেকে গুলশান-১ নম্বর পর্যন্ত সড়ক, নর্দমা ও ফুটপাত উন্নয়নকাজে সড়কজুড়ে সড়ক বিভাজক উঁচু করা হচ্ছে দেয়াল দিয়ে। এজন্য মহাখালী থেকে গুলশান পর্যন্ত বিভাজকের বিভিন্ন জায়গায় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। অনেক জায়গায় শেকড় কেটে ফেলায় গাছগুলো মরে যাচ্ছে।
২০১৭ সালে গুলশান শুটিং ক্লাব থেকে লেক পার্ক পর্যন্ত গুলশান অ্যাভিনিউ সড়ক বিভাজকের গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছিল। শেকড় কেটে ফেলায় মারা পড়েছিল আরও কিছু গাছ। ওই বছরই উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরে সড়ক ও ফুটপাত উন্নয়নকাজ চালাতে গিয়ে সড়কের পাশাপাশি ফুটপাতের গাছও কেটে ফেলা হয়।
মহাখালী থেকে বনানী সড়কের পাশের সবুজ বেষ্টনীর গাছপালা কেটে মহাখালীতে করা হয়েছে অস্থায়ী বাজার। সেতু ভবন, বিআরটিএ ভবন, সড়ক ও জনপথের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় করতে গিয়েও কাটা হয়েছে গাছ। বিমানবন্দর সড়ক ধরে বনানীর কাকলী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কের দুপাশের গাছপালা কেটে ‘সৌন্দর্যবর্ধন’ করা হয়েছে।
মেট্রোরেলের জন্য বেগম রোকেয়া সরণির এবং সড়ক উন্নয়ন কাজের জন্য আগারগাঁও থেকে শ্যামলী শিশু মেলা পর্যন্ত সড়ক বিভাজকের গাছও কেটে ফেলা হয়েছে। বিআরটি প্রকল্পের জন্য উত্তরায় কাটা হয়েছে গাছ।
উন্নয়নের নামে চলছে জলাশয় ধ্বংস
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উন্নয়নকাজের অংশ হিসেবে রাজধানীর হাতিরঝিলের একাংশ ভরাট করা হচ্ছে। এর ৪১টি খুঁটি বা পিলার বসবে হাতিরঝিলের ইস্কাটন অংশের পাড় ঘেঁষে। এক্সপ্রেসওয়ের অংশ হিসেবে হাতিরঝিল হয়ে কাঁটাবন দিয়ে পলাশী মোড় পর্যন্ত একটি উড়ালপথে সংযোগ সড়ক থাকবে। হাতিরঝিল ভরাট করা হচ্ছে মূলত এই উড়ালসড়ক নির্মাণের অংশ হিসেবে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ করতে বনানীর কাকলী থেকে বনানী রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের পশ্চিম পাশের জলাধার, কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিমানবন্দর সড়ক এবং রেললাইনের মাঝখানের জলাধার ভরাট হয়েছে। কুড়িল ফ্লাইওভার নির্মাণের সময়ও ভরাট করা হয়েছে জলাধার। তবে সেখানে একটি লেক রাখা হয়েছে। কুড়িল বিশ্বরোড- জোয়ারসাহারার মাঝখানের নিচু জমি ভরাট করে পূর্বাচল প্রকল্পের একটি সাইট অফিস করা হয়েছে। উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টর এলাকাটিও একসময় বিস্তীর্ণ জলাধার ছিল।
খিলক্ষেতের পুলিশ অফিসার্স হাউজিং, আশিয়ান সিটি, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ৩০০ ফুট সড়ক তৈরিতেও ভরাট হয়েছে জলাভূমি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আমিন বাজার ল্যান্ডফিল, একই এলাকায় মধুমতি মডেল টাউন ও আমিনবাজার জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রও করা হয়েছে জলাভূমি ভরাট করে। বনশ্রী, আফতাবনগর, সাঁতারকুল এবং ঢাকার পশ্চিমে মোহাম্মদপুরের বছিলা এবং আশেপাশের এলাকাও গড়ে তোলা হয়েছে নিচু এলাকা ভরাট করে।
কমছে জলশায়, সবুজ ও খোলা জায়গা
ঢাকায় দুই দশকের পরিস্থিতি নিয়ে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এই সময়ে নগরে জলাশয় ও খোলা জায়গার পরিমাণ কমে তিন ভাগের এক ভাগে নেমেছে। এই সময়ে এক দশকে নগরে সবুজ আচ্ছাদন বাড়লেও পরের দশকে তা আবার নিম্নমুখী হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এই জরিপটি চালানো হয় আরও চার বছর আগে। এর পর জলাশয় ভরাট আর গাছ কাটার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে আর নগর বনায়নের যে প্রকল্প ছিল, তাতেও গতি আসেনি। বিআইপি জানাচ্ছে, তাদের আরও একটি গবেষণা চলছে। সেটি এখনো প্রকাশ হয়নি।
তবে কাজ করতে গিয়ে দেখা গেছে, সবুজ, খোলা জায়গা ও জলাশয় আরও কমেছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, একটি ‘আদর্শ শহর’ গড়ে ওঠে কংক্রিট, সবুজ ও পানির সমন্বয়ে। অন্তত ২৫ শতাংশ সবুজ, ১৫ শতাংশ জলাধার থাকবে। বাকি ৬০ ভাগের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কংক্রিট এলাকা করতে পারে, বাকিটা ভবনের মাঝখানে খালি জায়গা হিসেবে থাকবে। কিন্তু ঢাকায় এখন মোট জমির ৮০ শতাংশের বেশি জায়গাজুড়ে কংক্রিট, ৯ শতাংশের কিছু বেশি এলাকায় সবুজ আচ্ছাদন টিকে আছে। খোলা জায়গা এবং জলাভূমি আছে পাঁচ শতাংশেরও কম।
বিআইপি জানিয়েছে, দুই দশকে জলাশয় ভরাট হয়েছে ১৩ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার, অর্থাৎ প্রায় ৭০ শতাংশ। খোলা জায়গা কমেছে ১২ দশমিক ৬৮ বর্গকিলোমিটার বা ৬৭ শতাংশ। গত এক দশকে সবুজ আচ্ছাদন কমেছে আগের চেয়ে ০ দশমিক ১২ বর্গকিলোমিটার। শতকরা হিসেবে সবুজের পরিমাণ কমে হয়েছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশে।
নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, প্রভাবশালী কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কারণেও প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে। কারণ এ কাজটি করা খুবই সহজ। পরিবেশ ধ্বংস করলে কোনো বাধা আসে না, কেউ শক্ত প্রতিবাদও করে না। ফলে গাছ ও জলাশয় দখলে মেতে উঠেছে ক্ষমতাসীনরা। ব্যবসায়ীদের মাঝেও মুনাফার লোভ, ব্যক্তি পর্যায়ে আইন না মানা, সবুজ এলাকা, খোলা জায়গা না থাকার প্রবণতা মারাত্মক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, শহরের উন্নয়ন কার্যক্রমে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে দ্বিচারিতা দেখা যাচ্ছে। সবুজায়নের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু গাছ কাটা হচ্ছে।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, সারাদেশে পরিবেশবিধ্বংসী কার্যক্রম চলছে। খেলার মাঠ, জলাধার, গাছ, পার্কের ওপর আঘাত আসছে। এসব দেখভালের দায়িত্বে কে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। উচ্চ আদালত হাতিরঝিলকে ঢাকার ফুসফুস বলছেন। সেই ফুসফুসে ৪১টি পিলার বা পেরেক ঢোকানো হলে কী অবস্থা দাঁড়াবে!
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, গাছ কিংবা জলাশয় ধ্বংস করে যে উন্নয়ন হচ্ছে, এটা হচ্ছে যুক্তিবিহীন আবেগী উন্নয়ন। বারবার জনমত উপেক্ষা করে উন্নয়নের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে তা হিতে বিপরীত হয়। আইন, বিধি, নির্দেশিকার আলোকে জনমত যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিলে তা জনগণের কাছে এবং স্বচ্ছতার প্রশ্নে গ্রহণযোগ্য হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, পরিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়ন করা যাবে না-এ কথা প্রধামন্ত্রী বার বার বলছেন। কিন্তু বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনেক সময় সেটি মানছে না। কখনো কখনো আমরাও অসহায় থাকি। কিছুই করার থাকে না।