
প্রতীকী ছবি
বজ্রপাতে প্রতিবছর অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। সরকারি হিসাবেই গত এক যুগে ৩ হাজারের বেশি মানুষ বজ্রপাতে মারা গেছে। বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে সরকারের পদক্ষেপগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বহুদিন থেকে বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চলে এ বিষয়ক একটি প্রকল্প নেওয়ার চেষ্টা করলেও তা আটকে আছে নানা প্রতিবন্ধকতায়।
বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০১৬ সালের মে মাসে বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণা করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিবছর শত শত কৃষক, গরিব প্রান্তিক মানুষ মারা যায়, কিন্তু সরকার কিছু করতে পারছে না। বজ্রপাতে মৃত্যু রোধে বহুদিন ধরে একটি প্রকল্প নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় তা এখনো নেওয়া যায়নি।
বজ্রপাতে মৃত্যুর মিছিল
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বজ্রপাতে ২০১৭ সালে ৩০৭ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৫৮ জন, ২০০০ সালে ২৫৫ জন, ২০২১ সালে ৩৬৩, ২০২২ সালে ৩৩৭ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন। চলতি বছর এ পর্যন্ত ৮০ জনেরও বেশি মারা গেছেন বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে। গত ৪ মে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঝড়বৃষ্টির সময় বজ্রপাতে সাতজনের মৃত্যু হয়। ১৭ মে ১৪টি গরুসহ একজন খামারিও মারা যান। এরপর ২৩ মে একদিনে বজ্রপাতে মারা যায় ১৩ জন।
জলে গেল টিআরের টাকা, ব্যর্থ তালগাছ রোপণের কর্মসূচি
বজ্রপাত রোধে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও দুর্নীতির কারণে তা সফল হয়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের (টিআর) নীতিমালা সংশোধন করে বজ্রপাত থেকে প্রাণহানি রোধে ১৫টি জেলায় ‘বজ্র নিরোধক দণ্ড, বজ্র নিরোধক যন্ত্র (লাইটনিং অ্যারেস্টার)’ স্থাপনে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় মন্ত্রণালয়। কিন্তু লুটপাট হয়ে যায় এ অর্থ। টাকা খরচ দেখানো হলেও অনেক জায়গায় বসেনি কোনো বজ্র নিরোধক দণ্ড ও বজ্র নিরোধক যন্ত্র। এ নিয়ে বহু চিঠি চালাচালি ও তদন্ত করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর।
বজ্রপাত রোধে এক কোটি তালগাছ রোপণের কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার। অনিয়ম ও দুর্নীতিতে এ উদ্যোগও মাঠে মারা যায়। গত বছর ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত আমরা’ শীর্ষক এক সংলাপে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেন, ৩৮ লাখের মতো তালগাছ লাগানোর পর দেখা গেল, যত্নের অভাবে মারা যাচ্ছে। তাই এটা বাতিল করে দিয়েছি। আর একটি তালগাছ বড় হতে ৩০ থেকে ৪০ বছর সময় লাগে। তাই এটি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান মনে হচ্ছে না।
আটকে আছে প্রকল্প
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, বজ্রপাতে মৃত্যু প্রতিরোধে ২০২০ সালে একটি প্রকল্প নেওয়ার উদ্যোগ নেয় মন্ত্রণালয়। তখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বলেছিল যেহেতু প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেশি, তাই একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাব্যতা যাচাই) করে সেই প্রতিবেদনসহ জমা দিতে হবে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে ফিজিবিলিটি স্টাডি করার জন্য বলে। পরে মন্ত্রণালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাডির প্রতিবেদনসহ ২০২২ সালে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে পরিকল্পনা বিভাগ এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত জানাবে বলে জানায়।
এরপর বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়ে গেলে গত এপ্রিল মাসে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে তাদের প্রকল্পটি প্রক্রিয়ার মধ্যে নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। এতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জানায়, প্রকল্পটি আগামী অর্থবছরে সবুজ পাতায় আসলে প্রক্রিয়ার মধ্যে নেবে।
সবুজ পাতা হচ্ছে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার দলিল, যেখানে সরকার আগামী অর্থবছরে কী কী নতুন প্রকল্প নেবে সেটার তালিকা থাকে। এ প্রকল্পগুলো একনেক অনুমোদন করে। সবুজ পাতায় না আসলে উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে সরকার বিবেচনায় নেয় না।
বিবিধ পরিকল্পনা
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুবিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বজ্রপাতপ্রবণ ১৫ জেলায় মৃত্যু ঠেকাতে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ২৩২ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় এক ডেসিমেল জায়গায় কনক্রিটের শেল্টার করা হবে। বজ্রপাতের সময় মাঠে কাজ করা বা খোলা জায়গায় থাকা মানুষ সেখানে আশ্রয় নেবে।
এক কিলোমিটার অন্তর অন্তর নির্মাণ করা হবে একেকটি শেল্টার। একই সঙ্গে বসানো হবে বজ্র নিরোধক যন্ত্র, এসব যন্ত্র ১০০ মিটার এলাকা বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা দিবে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় ১৫ জেলায় বজ্রপাতের ৩০ থেকে ৪০ মিনিট আগে মানুষের মোবাইল ফোনে সতর্ক করে মেসেজ যাবে। এই প্রকল্পের আওতায় বজ্রপাত থেকে বাঁচতে জনসচেতনতা বাড়ানোর কাজ করা হবে বলেও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, অডিট, এনডিআরসিসি) এবিএম সফিকুল হায়দার বলেন, ‘বজ্রপাতে মৃতু্য রোধে আমরা একটি প্রবল্প নিয়েছি। এটি নিয়ে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের মাধ্যমে ফিজিবিলিটি স্টাডি করিয়েছি। তারা পজিটিভ মতামত দিয়েছে। যাচাই-বাছাই কমিটির মিটিং হয়েছে। এখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে আমরা প্রকল্পটি শুরু করতে পারব। প্রকল্পের মোট ব্যয় এক হাজার ২৩২ কোটি টাকার মতো।’
সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর, ময়মনসিংহ-এ ১৫ জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে বলেও জানান অতিরিক্ত সচিব।