
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ছবি: সংগৃহীত
মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় ৫ শতাংশ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ শতাংশ কোটা রয়েছে। অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সর্বোচ্চ বয়স ৩২ বছর। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি ও নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও সংস্থা এ নিয়মগুলো মানছে না। তাই অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, কোটা পদ্ধতি কি আছে? যদি মানা না হয়, তাহলে নামকাওয়াস্তে এই পদ্ধতি রাখা হয়েছে কেন?
গত কয়েক বছরে সরকারি সংস্থায় নিয়োগের ক্ষেত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বয়সসীমা মানা হয়নি। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর, বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ক্ষেত্রে ৩২ বছর। ১৯৯৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় (তখনকার সংস্থাপন মন্ত্রণালয়) এক আদেশের মাধ্যমে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও জাতীয়কৃত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বয়সসীমা ৩২ বছর নির্ধারণ করা হয়েছিল।
সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের বয়সসীমা অনুসরণ না করা নিয়ে ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম’-এর কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষার বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী কাছে এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোটা মেনে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ভর্তি করার জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছেও চিঠি পাঠিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বয়সসীমা মানার বিষয়ে কোনো ব্যত্যয় হয়ে থাকলে আমরা ব্যবস্থা নেব। আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে জানিয়ে চিঠি দিয়েছি। তাদের জানিয়েছি।’
‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম’-এর কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষার বলেন, ‘আমাদের মনে হচ্ছে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ইচ্ছাকৃতভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের বয়সসীমার বিষয়টি মানছে না।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় ৫ শতাংশ কোটা প্রথমত বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ছিল, পরবর্তী সময়ে নাতি-নাতনি যুক্ত করা হয়। তবে মেডিক্যাল কলেজ বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ এবং নাতি-নাতনিদের জন্য ২ শতাংশ রাখলে রিট করেন একজন। পরে হাইকোর্ট সবার জন্য ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করার নির্দেশ দেন।
গত ১১ জুন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের কাছে লেখা এক চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল জানিয়েছে, মেডিক্যাল/ডেন্টাল কলেজে এমবিবিএস/বিডিএস/নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কোর্সসমূহের ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষ ভর্তি পরীক্ষার অনুষ্ঠিত হয়ে ভর্তি কার্যক্রম সমাপ্ত হয়েছে। কিন্তু সরকারি আদেশ অনুসরণ না করে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত নীতিমালা-২০২৩ অনুসরণ করা হয়েছে।
মেডিক্যাল/ডেন্টাল কলেজে এমবিবিএস/বিডিএস কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালা-২০২৩-এর ৮১ ধারায় বলা হয় মুক্তিযোদ্ধা সন্তান এবং সন্তানদের সন্তানাদির জন্য মোট আসনের ২ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকবে, যা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্র, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পরিপত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও অবমাননার শামিল।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকল মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ভর্তির জন্য ন্যূনতম ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ ও বিনা বেতনে লেখাপড়ার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়। যদিও ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারি কোটা নাতি-নাতনি পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। অন্যদিকে হাইকোর্ট (রিট পিটিশন নং-১১২৭৪/২০১৩) মুক্তিযোদ্ধা কোটা ২ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশ অনুসরণ করার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিবকে আদেশ দেন।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ সরকারি আদেশ এবং হাইকোর্টের রায়কে অমান্য করে নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী ভর্তি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মন্ত্রীকে অনুরোধ জানায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম।
অন্যদিকে ১৪ মে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে লেখা আরেকটি চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম জানায়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষ ভর্তি পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), সমন্বিত পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট), বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ অধিকাংশ ভর্তি পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা কোটা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না। যেমন বুয়েট, চুয়েট, রুয়েট, কুয়েটে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কাউকে ভর্তি করা হয় না। এদিকে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট আসন ৬৬০টির মধ্যে কোটা অনুয়ায়ী ৩৩ জন নেওয়ার কথা থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নেওয়া হচ্ছে মাত্র ১৩ জন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট আসন ১৬৬৬টির মধ্যে যেখানে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নেওয়ার কথা ৮৩ জন সেখানে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নেওয়া হচ্ছে মাত্র ২৮ জন।
নিয়োগে মানা হচ্ছে না বয়সসীমা
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১৯৯৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর এক আদেশের মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধা/শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরিতে প্রবেশকালে বয়সের উচ্চসীমা মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থীদের মতো ৩২ বছর নির্ধারণ করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এমন নির্দেশনা থাকার পরও সরকারি বিভিন্ন দপ্তর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা অনুসরণ করছে না।
এ অবস্থায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী সরকারি/আধা-সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত ও জাতীয়করণ করা প্রতিষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা অনুসরণের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্মর এক চিঠিতে।
চিঠিটি সংযুক্ত করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ২০ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে এক চিঠি পাঠায়। সেখানে জনপ্রশাসন সচিবের উদ্দেশে বলা হয়, প্রাপ্ত আবেদনখানা সদয় অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হলো।
গত কয়েক বছরের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার নিয়োগ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বয়সের সীমা মানা হয়নি। যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ভর্তিকোটা। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্টা মত দিয়েছেন এ ব্যাপারে একটি সার্বিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।