Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

কোরবানি ঈদে লঙ্কাকাণ্ড

Icon

প্রতীক সিফাত

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৩, ১৫:১১

কোরবানি ঈদে লঙ্কাকাণ্ড

কাঁচামরিচ। ছবি: সংগৃহীত

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির তালিকায় যুক্ত এবার কাঁচামরিচ। তবে সবচেয়ে বেশি লঙ্কাকাণ্ড হয়েছে কোরবানি ঈদ ঘিরে। বাজার ঘুরে দেখা যায়, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কাঁচামরিচের দাম তিন থেকে চার গুণ ছাড়িয়ে যায়। আর বছর ব্যবধানে দাম বাড়ে আট গুণ। ঈদের ওই সময়টায় দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিকেজি মরিচ বিক্রি হয় ৮০০ থেকে হাজার টাকায়। কোথাও আবার ১২শ টাকায় গিয়ে ঠেকে। 

টানা দুই মাস খরা, এরপর অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় নিত্যপণ্যটির দাম বাড়ে বলে দাবি করেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। তবে হঠাৎ করে এত বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সিন্ডিকেটকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এ বছর তীব্র তাপপ্রবাহ ও অতিবৃষ্টিতে কাঁচামরিচের উৎপাদন কম হয়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু যে হারে দাম বাড়ে তা ছিল অস্বাভাবিক। মূলত সরকারের দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে একটি গোষ্ঠী বাজারে এ অস্থিরতা তৈরি করেছে। 

দেশে এপ্রিল ও মে মাসে কয়েক দফায় তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা দেয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গ্রীষ্মকালীন কাঁচামরিচের উৎপাদন। এরপর হঠাৎ বৃষ্টি হলেও মরিচ গাছে পর্যাপ্ত ফুল আসেনি। সাধারণত জুনের মাঝামাঝি থেকে মরিচ সংগ্রহ শুরু করেন কৃষকরা। 

ভরা মৌসুম হলেও এবার তেমন উৎপাদন না হওয়ায় সংকট দেখা দেয় সরবরাহে। ঈদের কিছুদিন আগে থেকে কাঁচামরিচের কেজি ৪০০ টাকায় উঠে যাওয়ায় গত ২৫ জুন আমদানির অনুমতি দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। ২৬ জুন ভারত থেকে ৩৮ টন মরিচ আসে। কিন্তু এর পরদিন অর্থাৎ ২৭ জুন থেকে ১ জুলাই পর্যন্ত টানা পাঁচ দিন ঈদের ছুটিতে বন্দরে আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এতেই অস্থির হয়ে ওঠে কাঁচামরিচের বাজার। সুযোগটি কাজে লাগায় এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। সিন্ডিকেট গড়ে কাঁচামরিচের দাম বাড়িয়ে দেয়। ১ জুলাই দেশের বিভিন্ন বাজারে কাঁচামরিচের প্রতি কেজি দাম আগের রেকর্ড ভেঙে হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত মে মাস থেকে মরিচ গাছে ফুল আসা শুরু হয়। এরপর জুনের মাঝামাঝি থেকে জুলাই ও আগস্ট মাস পর্যন্ত ধাপে ধাপে মরিচ উত্তোলন করেন কৃষকরা। তবে এ বছর এপ্রিল ও মে মাসে কয়েক দফায় তীব্র তাপপ্রবাহে মরিচ গাছে পর্যাপ্ত ফুল আসেনি। আবার জুন মাসের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে গাছগুলো মরে যেতে থাকে। যেগুলো অবশিষ্ট রয়েছে অধিকাংশ গাছেই এখন নতুন করে ফুল আাসছে না। এতে চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে না। 

ঝিনাইদহের সদর উপজেলার কৃষক আব্দুল আজিজ বলেন, ‘২৩ শতক জমিতে কাঁচামরিচের চাষ করেছি। জুন থেকে আগস্ট-এ তিন মাস আমরা মরিচ উত্তোলন করি। প্রতি সপ্তাহে দুই মণ করে হলে তিন মাসে প্রায় ২৫ মণ উৎপাদন হতো। কিন্তু এ বছর পাঁচ মণও উৎপাদন হবে না। একবার ফুল এসে মরিচ হয়েছে। এরপর আর ফুল আসছে না। এবারের গরমে গাছগুলোর উৎপাদন নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষকের কাছে যেহেতু মরিচ কম এ কারণে দাম বাড়তি।’

কাঁচামরিচ বিক্রেতা মমতাজ হোসেন বলেন, ‘দেশীয় কাঁচামরিচ দিয়েই এতদিন চাহিদা মিটছিল। দামও সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে ছিল। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে বৈরী আবহাওয়ার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাঁচামরিচের উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাই দাম বাড়তে শুরু করে। আমরা ঈদের আগে যে কাঁচামরিচ ২০০ টাকায় কিনে বাজারে বিক্রি করলাম ২৪০-২৫০ টাকা কেজি দরে, ১ জুলাই তা মোকামেই কিনতে হয়েছে ৪০০ টাকা দরে। এর সঙ্গে পরিবহন খরচ রয়েছে, নষ্টসহ অন্যান্য কিছু মিলিয়ে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি।’  

হিলি স্থলবন্দরের কাঁচামরিচের আমদানিকারক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দেশের বাজারে কাঁচামরিচের সরবরাহ স্বাভাবিক ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত ২৫ জুন ভারত থেকে আমদানির অনুমতি (আইপি) দেয় সরকার। বন্দরের কয়েকজন আমদানিকারক বেশ কয়েক হাজার টন কাঁচামরিচ আমদানির অনুমতিও পায়। সেই মোতাবেক দীর্ঘ ১০ মাস বন্ধের পর ২৬ জুন থেকে বন্দর দিয়ে কাঁচামরিচ আমদানি শুরু হয়। আমদানিকৃত এসব মরিচ বন্দরে ২০০-২২০ টাকা কেজি দরে পাইকারিতে বিক্রি করা হয়। বর্তমানে ভারতের মোকামেই কাঁচামরিচের দাম বেশি। তার ওপর রপ্তানি শুরু হওয়ায় কেজিতে আর ২০ টাকা করে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে করে ভারত থেকে ওই দামে কাঁচামরিচ কিনে এর সঙ্গে গাড়ি ভাড়া খরচ হিসাব করে দাম বেশিই পড়ছে। এছাড়া এক কেজি কাঁচামরিচ আমদানিতে শুল্ক দিতে হচ্ছে ৩৫ টাকা। সব মিলিয়ে কাঁচামরিচ আনতে গিয়ে যে পড়তা পড়ছে তাতে করে খুব একটা দাম কমার সম্ভাবনা নেই। তবে যদি আমদানি শুল্কটা কমানো হয় তাহলে মানুষ কিছুটা কম দামে কাঁচামরিচ খেতে পারবে।’ 

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘কাঁচামরিচের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। কোরবানির ঈদের কারণে সরবরাহ সংকট কিছুটা হতে পারে। কিন্তু তাই বলে এত মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে না। যে কোনো পণ্যের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সরবরাহ সংকটের অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এ বছর কাঁচামরিচের উৎপাদন গত বছরের প্রায় কাছাকাছিই হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন মিলিয়ে ২ লাখ ৯৮ হাজার টন মরিচ উৎপাদন হয়। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৯০ হাজার টনের বেশি। 

এদিকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব মতে, গত ২ জুলাই কাঁচামরিচের পাইকারি দর ছিল ৫৬০ টাকা এবং খুচরায় ৫৮০ টাকা। তার আগের সপ্তাহেও যেটা ছিল প্রায় অর্ধেক। অর্থাৎ পাইকারিতে ২৪০ টাকা এবং খুচরা বাজারে ৩০০ টাকা কেজিতে ওই সময় বিক্রি হয় পণ্যটি। এক মাস আগে ছিল তারও অর্ধেক, পাইকারিতে ১২০ ও খুচরা বাজারে ১৬০ টাকা কেজি।

আর গত বছর এ সময়ে কাঁচামরিচের কেজি ছিল পাইকারিতে ৮০ ও খুচরায় ১০০ টাকা। কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ৩৬ হাজার ৮৩০ টন কাঁচামরিচ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আমদানির এ অনুমতি আগামী তিন মাসের জন্য বহাল থাকার কথা রয়েছে। এ মরিচ আসা অব্যাহত থাকলে দেশের বাজারে দাম প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকায় নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

হঠাৎ করে কাঁচামরিচের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ার কারণ জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘আবহাওয়ার কারণে কাঁচামরিচের উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে যে হারে কয়েক দিনের মধ্যে দাম বেড়েছে তা অস্বাভাবিক। দাম বাড়ছে দেখেই আমরা আমদানির অনুমতি দিয়েছি। কাঁচামরিচের উৎপাদন কিছুটা কম হতে পারে। কিন্তু এত কম হয়নি যে দাম এত বাড়াতে হবে।

আশা করছি কয়েক দিনের মধ্যে দাম কিছুটা কমে আসবে।’ দেশীয় উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ বাড়ায় কাঁচামরিচের দাম দ্রুত কমে আসছে। পাইকারি বাজারে ৩ জুলাই দুপুর পর্যন্ত মানভেদে মরিচের দাম নেমে আসে ১৫০ থেকে ২৪০ টাকার মধ্যে। তবে রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে তখনো ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজিতেই নিত্যপণ্যটি বিক্রি হতে দেখা গেছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫