
প্রতীকী ছবি
বিশ্বের অধিকাংশ দেশের ‘সাধারণ নিয়ম’ হলো নির্দিষ্ট দপ্তরে ও বিভাগে সেই কাজে বিশেষভাবে অভিজ্ঞ ব্যক্তি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। আর বাংলাদেশে হয় উল্টোটা। ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তা হন ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এবং আইনজীবী হন নগরের মেয়র। এ তো মাত্র তিনজনের ডোশিয়ার। এ রকম ডজন ডজন নজির আছে এদেশে।
দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে। চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬১ জনে। প্রতিদিন বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।
মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আশপাশের এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। ঢাকার বাইরেও বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের গত বুধবার থেকে শুক্রবার-এই তিন দিনের চিত্র ভয়াবহ। করোনাপরবর্তী এত মৃত্যু এর আগে হয়নি।
অথচ ডেঙ্গুর ‘মৌসুম’ শুরু হওয়ার আগে মশা নিয়ন্ত্রণের নামে প্রায় পৌনে দুইশ কোটি টাকা হাপিস হয়ে গেছে। কাদের পকেটে গেছে সে কথা বলেও আর লাভ নেই। তাতে করে মৃতরা ফিরে আসবে না। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার আগে দুই সিটি মেয়রের হম্বিতম্বিও ছিল চোখে পড়ার মতো। ঠিক যেমনটি তারা কোরবানির আগে বর্জ্য পরিষ্কার করার চ্যালেঞ্জ করে থাকেন। ঠিক এ মুহূর্তে ঢাকা শহরের মশা প্রজননের স্থানের ছবি ছাপালে পত্র-পত্রিকায় অন্য কিছু লেখার জায়গা থাকবে না।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি প্যানিক হতে চলেছে, অন্তত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভবিষ্যদ্বাণীর অর্ধেকটা ফলে গেলেই। তিনি আশঙ্কা করছেন আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে! তার আশঙ্কা এমনি এমনি নয়। ইতোমধ্যে দেশের ৫৭টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। মন্ত্রী বলেন, ‘দেশে যত লোক ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে তার মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি।
মোট আক্রান্তের শতকরা ৬০ ভাগই ঢাকার বাসিন্দা। এখন সারা দেশেই বৃষ্টি হচ্ছে। পানি জমে থাকছে। এতে ডেঙ্গুর লার্ভা হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভার মেয়ররা ডেঙ্গুর বিস্তার প্রতিরোধে কাজ করছে। তবে এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি।’ এই যে তিনি বললেন-‘পৌরসভার মেয়ররা ডেঙ্গুর বিস্তার প্রতিরোধে কাজ করছে। তবে এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি।’ একে বলে ‘স্বজাতিতোষণ’। এক বিভাগ আরেক বিভাগের ওপর দায় চাপিয়ে আবার এভাবে রক্ষাও করেন।
এ বছর পিক টাইমের আগেই কেন ভয়াবহভাবে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ল, কেন পিক টাইমের আগেই সারাদেশে ৬১ জন মারা গেল তার কোনো সদুত্তর নেই। তারা ‘ইতোমধ্যে ঢাকা দুই সিটির ৫৫টি ওয়ার্ডকে ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেই বিরাট কম্ম করে ফেললেন। কী সুন্দর স্বাস্থ্য সুরক্ষার নজির! একটা শহরের এতগুলো ওয়ার্ড যদি ঝুঁকিঁপূর্ণ হয় তাহলে বাকি থাকল কয়টি? এই প্রশ্ন কেন ওঠে না যে প্রায় দুইশ কোটি টাকা খরচ হলো কীভাবে? কেন আগে থেকে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হলো না? প্রতিবছর এই একই ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছেন তারা। কোন দুঃসাহসে?
তারা ডেঙ্গু প্রকোপের চটজলদি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন, ‘উন্নয়নমূলক কার্যক্রম, রাস্তা উঁচু হওয়া, ভবনের নিচতলায় কিংবা পার্কিংয়ে জমে থাকা পানির কারণে লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে বেশি।’ শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ বলেছেন, ‘শক সিন্ড্রোমের কারণে বেশি মানুষ মারা যেতে পারে। তাই অবহেলা না করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেওয়ামাত্রই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।’ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে কী করতে হবে তা যেন কেউ জানে না! অথচ এদের প্রশ্ন হওয়া উচিত ছিল, কেন যথাসময়ে মশার বিস্তার রোধ করা গেল না? না, তারা তা বলবেন না। কারণ তাতে করে স্বগোত্রীয় আমলাদের গায়ে লাগে।
কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর চৌধুরী বলছেন, ‘ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বছরব্যাপী নানা উদ্যোগ নিলেও মশা নিধনে শুধু জেল-জরিমানা আর জনসচেতনতা বাড়িয়ে কাজ হবে না। সঠিকভাবে জরিপ চালিয়ে দক্ষ জনবল দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।’ এই যে তিনি বললেন, ‘জেল-জরিমানা আর জনসচেতনতা বাড়িয়ে।’ এটা কেউ দেখেছেন যে মশা দমনে ব্যর্থতার জন্য কারও জেল-জরিমানা হয়েছে?
এই যে ‘জরিপ চালিয়ে’ বা ‘ব্যবস্থা নিতে হবে’ শব্দগুলো এমন কোনো সেক্টর আছে যেখানে ব্যবহৃত হয় না? প্রত্যেকটা অযোগ্য পরিচালিত সেক্টরে এই একটিই ‘ইনডেমনিটি’-‘যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।’ কবে সেই ‘যথাযথ ব্যবস্থা’ নেবেন জানার উপায় নেই। কারণ রুলস অব বিজনেস সংশোধন করে করদাতা নাগরিকদের সে প্রশ্ন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। করদাতা নাগরিকরা, এমনকি সাধারণ প্রশ্নও করতে পারেন না। করদাতারা সারা বিশ্বেই শাসকদের প্রশ্ন করা, এমনকি জবাবদিহির অধিকার রাখেন। এখানে ‘বিশ্বখ্যাত উন্নয়নের মচ্ছবে’ সেই সুযোগটুকুও নেই। তা নিয়ে বিরোধী দলগুলোরও কোনো হেল-দোল নেই।
সুতরাং বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের যুগে সামান্য এক মশার কামড়ে আমাদের গণ্ডারের চামড়াধারী নাগরিকদের মৃত্যুবরণ করতে হবে, আরও হরেক কিসিমের তুচ্ছ কারণে মৃত্যুর মতোই স্বাভাবিকভাবে। নো ওয়ে। আপনার বাড়ি-ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে ভাববেন আপনি নিরাপদ? কস্মিনকালেও না, কারণ আপনি পচা এঁদো নোংরা নর্দমা পরিবষ্টিত এবং মনুষ্য বসবাসের অনুপযুক্ত এক পরিত্যক্ত রাজধানী এবং সেই রাজধানী কর্তৃক শাসিত দেশে বসবাস করছেন।