
১৯৯০ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত বিশ্বে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। আর এ দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। সাধারণত ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স’ যদি শূন্য থেকে ৫০ পর্যন্ত থাকে, তবে তা ভালো, ৫১-১০০ ঠিকঠাক। ১০১-২০০ হলে মোটামুটি পর্যায়ে।
২০১-৩০০ খারাপ। ৩০১-৪০০ খুব খারাপ, ৪০১-৫০০ হলে মারাত্মক। এর বেশি হলে ‘অতি মারাত্মক’। ঢাকা কিংবা ভারতের দিল্লিতে পালাক্রমে এই শীর্ষস্থান দখলে কয়েক মাস ধরে ওঠানামার দৃশ্য দেখা গেছে। ধুলাবালি মিশ্রিত বাতাসের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে।
অন্যদিকে শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও নিরাপত্তাহীনতা দিন দিন বেড়েই চলছে। এই সমস্যা পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব না হলেও কিছু সচেতনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ তা অনেক কমিয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা। তবে এত সবের মধ্যে ব্যবস্থার তুলনায় আশঙ্কার পরিমাণ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। বায়ুদূষণ নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম থেমে নেই। সেখান থেকেই আসছে একেরপর এক ভয়াবহ তথ্য। সবশেষ প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, বায়ুদূষণে বিশ্বে মানুষের আয়ু কমছে গড়ে ৩ বছর।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বায়ুদূষণে প্রতি বছর ৮৮ লাখ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করছেন। চিকিৎসাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর বিশ্বে ম্যালেরিয়া, এইডস, হৃদরোগের মতো ভয়ংকর রোগের চেয়েও বেশি মৃত্যু হচ্ছে। প্রতিবেদনে বায়ুদূষণকে ‘মহামারি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারির তুলনায় বায়ুদূষণেই বেশি মানুষের অকালমৃত্যু হচ্ছে। ম্যালেরিয়ার তুলনায় ১৯ গুণ এবং এইডসের তুলনায় প্রায় ৯ গুণ বেশি মানুষ বায়ুদূষণের কারণে অকালে মারা যাচ্ছে। বায়ুদূষণ থেকে শুধু ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে প্রায় ছয় শতাংশ মানুষ। এর প্রভাবে ফুসফুসের অন্যান্য রোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
গবেষণার প্রধান লেখক জস লেলিয়েভেল্ড বলেছেন, ‘জনস্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব ধূমপানের চেয়েও ক্ষতিকর। তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে এ ক্ষতি কমানো সম্ভব।’ তিনি জানান, তেল, গ্যাস, কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপন্ন দূষণ সৃষ্টিকারী কণার প্রভাব মানুষের ফুসফুসে প্রায় এক বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় এশিয়ায় বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি। বায়ুদূষণের কারণে চীনে ৪.১, ভারতে ৩.৯ এবং পাকিস্তানে ৩.৮ বছর গড় আয়ু কমেছে। ধনী দেশগুলোর তুলনায় দরিদ্র দেশে বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি। যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর ও পশ্চিম ইউরোপ এবং দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোতে বায়ুদূষণ তুলনামূলকভাবে কম।
ধনী দেশগুলোর মধ্যে রোমানিয়া, বুলগেরিয়া এবং হাঙ্গেরিতে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হয়। গবেষক টমাস মাঞ্জেল বলেন, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অকালমৃত্যুর জন্য মূলত মানবসৃষ্ট দূষণই দায়ী। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে বছরে প্রায় ৫৫ লাখ মানুষকে অকালমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব। শুধু স্বাস্থ্যগত সমস্যাই নয়, কিছুদিন আগে অপর এক গবেষণায় দাবি করা হয়, বায়ুদূষণজনিত রোগে বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর অকালমৃত্যু হচ্ছে ৪৫ লাখ মানুষের, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সংস্থাটি বায়ুদূষণের কারণে ৪২ লাখ মানুষ মারা যাওয়ার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করেছিলো। অকালমৃত্যুর শিকার হওয়া মানুষের মধ্যে শুধু চীনেই মারা যাচ্ছে ১৮ লাখের বেশি আর ভারতে মরছে প্রায় ১০ লাখ।
তবে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের কারণে পৃথিবীর বায়ু দূষিত হয়ে মানুষ যে শুধু স্বাস্থ্যগত ক্ষতির মুখে পড়ছে তাই নয়, প্রতি বছর ক্ষতি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থেরও। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (সিআরইএ) এবং গ্রিনপিস সাউথ এশিয়া নামের দুটি প্রতিষ্ঠান হিসাব করে দেখায়, ২০১৮ সালে বিশ্বে প্রতিদিন ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়েছে বায়ুদূষণের কারণে। আর পুরো বছরে এ ক্ষতির পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৯২ হাজার কোটি ডলারের বেশি; যা বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ৩.৩ শতাংশ।
গত বছরের মার্চে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৮ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বায়ুদূষিত দেশের তালিকায় শীর্ষে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে সবচেয়ে দূষিত ৩০ শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৭তম। আইকিউএয়ার, এয়ারভিজ্যুয়াল ও গ্রিনপিসের ওই গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে। বাতাসের মধ্যে পিএম২.৫ নামে পরিচিত এক ধরনের সূক্ষ্ম কণার উপস্থিতি থাকে। এই কণাগুলো মানুষের ফুসফুস ও রক্তপ্রবাহে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। বায়ুদূষণের শীর্ষে থাকা বাংলাদেশের বাতাসে পিএম২.৫-এর গড় মাত্রা ৯৭.১, যা মারাত্মক বলে ঘোষণা দেয়া হয়।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রূপকল্প-২০২১ ও ২০৪১-কে সামনে রেখে বাংলাদেশ তার স্বপ্ন অভিযাত্রার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তবে এসডিজি এবং বায়ুদূষণে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি পুরোপুরি সাংঘর্ষিক অবস্থানে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণকে এড়িয়ে কোনোভাবেই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। বিশ্ব ব্যাংকের ‘বাংলাদেশের নগর এলাকায় পরিচ্ছন্নতা ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা: দেশের পরিবেশগত বিশ্লেষণ-২০১৮’ প্রতিবেদনেও দেখা যায়, দূষণে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। ২০১৫ সালেই নগর এলাকায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু দূষণের কারণে হয়েছে। বিশ্বে ১৬ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয় দূষণে।
এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক দেশকালকে পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘বায়ুদূষণের সমস্যা সমাধানে পরিবেশ অধিদপ্তরকে কাজ করতে হবে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, আইন বিধিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করতে হবে। গ্যাস পোড়ালেও রান্নাঘরের পরিবেশ দূষিত হয়। এ জন্য বিভিন্ন জ্বালানির স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত চার দিকে ছড়িয়ে দিতে হবে। জনগণকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে কীভাবে দূষণমুক্ত জীবনযাপন করতে পারে। বায়ুদূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদের উদ্বেগ তৈরি করতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি দপ্তর বিশেষ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও এর সংস্থাগুলোকেও কাজে লাগাতে হবে। চিকিৎসকদের বায়ুদূষণের প্রভাব সম্পর্কে সরকারকে ধারণা দিতে হবে। আইন অনেক হয়েছে, এগুলো প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ২০৭০ সালের মধ্যে দেশের কৃষিজমি নাই হয়ে যাবে। তাই ইটভাটা ও আবাসন শিল্পে জমির ব্যবহারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।’
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বায়ুদূষণের ফলে কেবল ফুসফুসকেন্দ্রিক রোগ বিস্তার লাভ করে এমন নয়। এর মাধ্যমে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশের মতো মারাত্মক রোগও ছড়িয়ে পড়তে পারে। পাশাপাশি অনেক ছোটখাটো রোগবালাইসহ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক অবসাদ ও শিশুদের মধ্যে অ্যাজমার মতো রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।