Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

বস্তিতেই কেন আগুন লাগে?

Icon

মাহমুদ সালেহীন খান

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২০, ১০:১২

বস্তিতেই কেন আগুন লাগে?

ফাইল ছবি

গত কয়েক বছরে ঢাকার ও ঢাকার বাইরের বস্তিগুলো আগুনে পুড়েছে অনেকবার, নিভেছে অনেক জীবনপ্রদীপ। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার মিরপুরে রূপনগর বস্তিতে লাগা আগুনে প্রায় ১০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। 

জনমনে প্রশ্ন জাগছে, বারবার বস্তিতে কেন আগুন লাগে? কেন এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না? বস্তিতে বারবার আগুন লাগে নাকি লাগিয়ে দেয়া হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এখন সময়ের দাবি। 

এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আধিপত্য বিস্তার ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলদারিত্বের কারণেই একের পর এক বস্তিতে আগুন লাগানো হয়।

দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, গত প্রায় চার বছরে ছোট ছোট দশটি বস্তি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এসব বস্তির বাসিন্দারা বড় বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন। ঢাকায় বস্তিতে বসবাস করছেন কয়েক লাখ হতদরিদ্র মানুষ। তবে বস্তি ও বস্তিবাসীর সংখ্যা কত- এর সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের কাছে নেই। বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০১৪ সালে বস্তিশুমারি করেছিল পরিসংখ্যান ব্যুরো। এরপর এ নিয়ে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রতি বছর নদীভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা শুধু কাজের খোঁজেই লাখো মানুষ ঢাকায় আসছেন। 

২০১৪ সালের বস্তিশুমারি অনুযায়ী, ঢাকা শহরের দুই সিটি কর্পোরেশনে মোট ৩ হাজার ৩৯৪টি বস্তি রয়েছে। সেখানে মোট ঘরের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজারের মতো। ওই জরিপ অনুযায়ী, সে সময় সাড়ে ছয় লাখের মতো লোক এসব বস্তিতে বসবাস করেন। অর্ধেকের বেশি বস্তি সরকারি জমিতে তৈরি। ৬৫ শতাংশ বস্তিবাসী ভাড়া থাকেন। 

২০১৪ সালের শুমারি অনুযায়ী, সারাদেশে বস্তিবাসীর সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। তবে এসব সংখ্যা ও তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ২০১৪ সালের পর এখন বস্তি বা বস্তিবাসীর সংখ্যা কত তার কোনো হিসেব কারও জানা নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘বস্তিবাসীর সংখ্যা বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ১৯৯৭ সালের পর বস্তিশুমারি হয়েছে ২০১৪ সালে। সরকারি হিসাবেই এই সময়ের মধ্যে বস্তির সংখ্যা ছয়গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা যখন করা হয়, তখন এই বিশাল জনসংখ্যার কথা খুব একটা মাথায় রাখা হয় না।’ 

ফায়ার সার্ভিসের ২০১৮ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সারা বছর দেশজুড়ে ১৬৫ বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড হয়। এর মধ্যে ঢাকাতেই ৩৩ বার বস্তিতে আগুন লাগে। গত ১০ বছরে শুধু ঢাকার কড়াইল বস্তিতেই আগুন লেগেছে ১৭ বার! একই বস্তিতে বারবার আগুন লেগেছে। এরপরও পরিস্থিতি এতোটাই স্বাভাবিক যে, পরিসংখ্যান দেখেও কারো চোখ কপালে উঠবে না। মৌসুম এলে যেমন গাছে ফল ধরে, সেভাবেই সময় করে বস্তিতে আগুন লাগে।

বস্তিতে কেন বারবার আগুন লাগে জানতে চাইলে নয়াগণতান্ত্রিক গণমোর্চার সভাপতি জাফর হোসেন বলেন, ‘নানা কারণেই বস্তিতে আগুন লাগে। বিভিন্ন সময়ে তদন্তে শর্টসার্কিট ও গ্যাসের পাইপের লিক থেকে আগুনের কারণ উঠে এসেছে। তবে আগুন যে লাগানো হয়, সে কথাটাও অমূলক নয়। বস্তিতে আগুন লাগার পেছনে কোনো মহলের ইনফ্লুয়েন্স তো থাকেই। বিশেষ করে যারা ভুক্তভোগী তারা তো জানেন, এই আগুনের কলকাঠি নাড়ছে কে। বস্তি উচ্ছেদ করে সেখানে নতুন করে বস্তি তৈরি করার লাভটাও নেহায়েত কম নয়। বস্তির দখল যাদের হাতে থাকে, তারাই এমন পরিস্থিতির ফায়দা লোটেন, আগুন থেকে ক্যাশ আউট করে থাকেন। কিংবা বস্তির জমিতে অন্যকিছুর পরিকল্পনা করা হলে সে ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। সব আগুনেই স্বার্থন্বেষী ক্ষমতাবান দুষ্টচক্র জড়িত থাকার ইঙ্গিত থাকে।’

তিনি আরো বলেন, ‘বস্তিতে নিয়মিত বিরতিতে অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলা হয় না। হতাহত হলেই কেবল মামলা হয়, তাও অপমৃত্যুর। এরও আবার তদন্ত হয় না। এখন পর্যন্ত যত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তাতে হয়েছে দফায় দফায় তদন্ত কমিটি, ভারী হয়েছে সুপারিশের তালিকা। তবে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগের অভাবে থেকেছে কাগজপত্রের গণ্ডিতেই। গত পাঁচ বছরে দেশের বস্তিগুলোয় এক হাজার ২০০টির বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও একটিরও অভিযোগপত্র দাখিল করেনি পুলিশ। স্বাভাবিকভাবেই এসব অগ্নিকাণ্ডে কাউকে দায়ী করা যায়নি।’

কেন বস্তিতে আগুন লাগে- এই প্রশ্নের উত্তরে নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, ‘দুর্ঘটনাজনিত কারণে বস্তিতে বারবার আগুন লাগে না। বরং বস্তিতে আগুন লাগানো হতে পারে। সব আগুনেই কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহল, প্রশাসন ও স্থানীয় প্রভাবশালী মহল জড়িত থাকতে পারে।’ 

বস্তি কেন গড়ে ওঠে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সব বস্তির মানুষ আসে দেশের নানা প্রান্ত থেকে। নগর ও গ্রামের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানাবিধ প্রাকৃতিক আপদ যেমন- বন্যা, নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, শৈতপ্রবাহ, লবণাক্ততার কারণে মানুষ জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসেন। এসব মানুষ আশ্রয় নেন শহরের বস্তি অথবা ফুটপাতের কোনো খোলা জায়গায়। এখানে এসেও তাদের স্বস্তি নেই। প্রায়ই স্বার্থের বলি হতে হচ্ছে তাদের। মনুষ্যসৃষ্ট আগুনে অসহনীয় হয়ে উঠছে তাদের জীবন। এসব বস্তির অধিকাংশই গড়ে ওঠে ব্যক্তি মালিকানায় অথবা স্থানীয় দালাল চক্রের নিয়ন্ত্রণে। ভাড়া বা চাঁদা নেয়ার সামান্য তারতম্য হলেই চলে উচ্ছেদ। আর এই উচ্ছেদের নতুন পথ হলো অগ্নি-থেরাপি; অগ্নিকাণ্ডে নিঃস্ব করে তাদের সরিয়ে দেয়া।’

আগুনের সাথে সবচেয়ে বেশি সখ্য যেন বনানীর কড়াইল বস্তির। গত ১০ বছরে বস্তিটি পুড়েছে ১৭ বার। গত তিন বছরে ছয়বার পুড়ে আগুনে। এর মধ্যে এক বছরেই পুড়ে তিনবার। এসব আগুন স্বাভাবিক কারণে লেগেছে, এমনটা মানতে নারাজ উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদ আল তিতুমীর। 

তিনি বলেন, ‘এসব আগুন নাশকতার অংশ। কড়াইলের একটি বস্তিতেই এক বছরে যখন তিনবার আগুন লাগে, তখন আপনাকে বুঝতে হবে এটা স্বাভাবিক কোনো আগুন নয়। বস্তিতে আগুন লাগা এখন আর কোনো নতুন বিষয় নয়। একের পর এক বস্তি পুড়ছে আর গৃহহীন হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। অথচ এ বস্তিবাসীরাই শহর জীবনের চালিকাশক্তি। তাদের শ্রমেই টিকে আছে নগরের যানবাহন, গার্মেন্টস, শিল্প কারখানা, হাট-বাজার, গৃহকর্মীর সেবাসহ নানা ব্যবস্থা। এই ব্যয়বহুল শহর তাদের বসবাসের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থাই করা হয়নি। তারা যেমন জীবিকার প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে, এই শহরও তেমনি তাদের লুফে নেয় নিজেদের স্বার্থে। এদের ছাড়া একদিনও চলে না নগরীর অর্থবিত্তের মালিকদের।’

তিনি বলেন, ‘অথচ বিভিন্ন প্রকল্পের নামে তাদেরকে উচ্ছেদ করা হয় বুলডোজার দিয়ে। দখলমুক্ত করতে কোনো কোনো সময় বুলডোজার হেরে গেলে লাগিয়ে দেয়া হয় আগুন! এ দেশের মানুষ এটাই দেখে আসছে বারবার।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫