
প্রতীকী ছবি। গ্রাফিক্স: সাম্প্রতিক দেশকাল
এবছর ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়তে পারে। এমন সতর্কতা বছরের শুরুতেই জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু সেই সতর্কবার্তা কোন সিটি করেপোরেশন বা স্থানীয় সরকারের কোন বিভাগ আমলে নেয়নি বলেই মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। যার কারণে ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। রাজধানীর পাশাপাশি আশপাশের জেলার রোগীর চাপও সামলাতে হচ্ছে ঢাকার হাসপাতালগুলোকে। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হারে সব রেকর্ড ভেঙেছে। এমন পরিস্থিতিতে মশানিধনের কার্যক্রম আরও বেগবান করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই সঙ্গে জনগণকে সচেতন করতে না পারলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়ানক রুপ নিতে পারে বলে উদ্বেগ তাদের।
তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে বর্তমানে সবচেয়ে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এছাড়া অন্যান্য প্রায় সব হাসপাতালেই শয্যা ফাঁকা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, কয়েকটি এলাকায় এখনও ডেঙ্গু সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে অন্যতম হলো- যাত্রাবাড়ী, মুগদা, উত্তরা, জুরাইন ও মিরপুর। এসব এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী যাত্রাবাড়ী এলাকায়। বিভাগীয় পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, আক্রান্তের দিক থেকে ঢাকার পরেই চট্টগ্রামের অবস্থান।
সারাদেশে এডিস মশা মারতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব কঠিন হবে বলেও জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, শুধু ঢাকা নয়, ডেঙ্গু যতটা মেডিকেল প্রবলেম, তার থেকে বেশি এনভায়রনমেন্টাল প্রবলেম। এক্ষেত্রে পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং বেশি জরুরি।
একই ধরনের শঙ্কার কথা জানিয়েছেন হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি মনে করেন, চলতি আগস্ট ও আগামী সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব আরও বেড়ে যাবে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি সম্পর্কে ডা. লেলিন চৌধুরী জানিয়েছেন, যেভাবেই হোক বর্তমানে ডেঙ্গু রোগের লক্ষণগুলো বেশ বদলে গিয়েছে। এবছর ডেঙ্গুর যে প্রকার দেখা যাচ্ছে, সেগুলো সেকেন্ডারি ফর্মের। অর্থাৎ আগে যিনি ডেঙ্গুর অন্য কোনো উপধরন দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি এখন আরেকটি ধরণ বা উপধরণ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বার যখন কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় তখন মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এবারে তাই হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, গতবছর ১২৯টি দেশে মোট প্রায় ৫২ লক্ষ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। চলতি বছরে ইতিমধ্যেই লাতিন আমেরিকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, পেরু, প্যারাগুয়েতে ডেঙ্গু ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে। করোনার মতোই ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে ডেঙ্গু- এমনটাই আশংকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার জানিয়েছেন, থেমে থেমে যে বৃষ্টিপাত হচ্ছে, এটি মশা প্রজননের জন্য আরো উপযোগী। সুতরাং অবনতি যে হচ্ছে, সেটা বলা যায়। ঢাকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে।
তিনি বলেন, এ মুহূর্তে মশা নিয়ন্ত্রণে জনসম্পৃক্ততা খুব প্রয়োজন। সমাজসেবামূলক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বাসাবাড়িতে যেসব স্থানে পানি জমে থাকে, সেখানে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই। নারায়ণগঞ্জ ও রংপুর সিটি করপোরেশনে একজন করে কীটতত্ত্ববিদ আছেন। দেশের বাকি আট সিটি করপোরেশনে অর্থাৎ খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা, গাজীপুর, সিলেট ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই।
মশা মারতে আজ থেকে বিটিআই নিয়ে মাঠে নামছে ডিএনসিসি
ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এডিস মশা মারতে আজ রবিবার (০৬ আগস্ট) থেকে নতুন কীটনাশক বিটিআই প্রয়োগ শুরু করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। ডিএনসিসি জানিয়েছে, এই কীটনাশকের পুরো নাম বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস। ২৫ গ্রামের এক প্যাকেট বিটিআই ১০ লিটার পানিতে ২৫ থেকে ৫০ বর্গমিটার এলাকায় ছিটাতে হয়।
প্রাথমিকভাবে ঢাকার সড়কের পাশের নালায় এই ওষুধ ছিটানো হবে বলে জানিয়েছে ডিএনসিসি। মশা নিধনে এই কীটনাশক কতটা কার্যকর? এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার জানান, গবেষণাগারে আমরা মশা মারতে এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করেছি। এতে খুব ভালো ফল পাওয়া গেছে। বিভিন্ন দেশে গবেষকরা ল্যাবরেটরি ও মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এটিকে মশার লার্ভা দমনে কার্যকর উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
গতকাল শনিবার বিএসএমএমইউর কনফারেন্স রুমে `ডেঙ্গুবিরোধী সামাজিক আন্দোলন চাই' শীর্ষক আলোচনা সভায় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে এটি স্ট্রেইন নির্ভর। যেহেতু ডেঙ্গুর একাধিক স্ট্রেইন একটিভ রয়েছে। ফলে কোনটা কার্যকর হবে সেটি গবেষণা প্রয়োজন। বিএসএমএমইউতে ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের ব্যাপারে গবেষণা করে তৈরি করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগকে দ্রুত কাজ শুরু করার জন্য নির্দেশ দেন। জ্বর হলে ঘরে বসে না থেকে দ্রুত এনএসওয়ান টেস্ট করার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না। প্রচুর তরল খাবার খেতে হবে।