Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও অবনতির শঙ্কা

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৩, ১৬:০১

ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও অবনতির শঙ্কা

প্রতীকী ছবি। গ্রাফিক্স: সাম্প্রতিক দেশকাল

এবছর ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়তে পারে। এমন সতর্কতা বছরের শুরুতেই জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু সেই সতর্কবার্তা কোন সিটি করেপোরেশন বা স্থানীয় সরকারের কোন বিভাগ আমলে নেয়নি বলেই মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। যার কারণে ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। রাজধানীর পাশাপাশি আশপাশের জেলার রোগীর চাপও সামলাতে হচ্ছে ঢাকার হাসপাতালগুলোকে। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হারে সব রেকর্ড ভেঙেছে। এমন পরিস্থিতিতে মশানিধনের কার্যক্রম আরও বেগবান করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই সঙ্গে জনগণকে সচেতন করতে না পারলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়ানক রুপ নিতে পারে বলে উদ্বেগ তাদের।

রাজধানীর তুলনায় ঢাকার বাইরে আক্রান্তের হার বেশি 
ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার কিছুটা বাড়লেও রাজধানীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্তের হার মোটামুটি স্থিতিশীল, তবে ঢাকার বাইরে আক্রান্তের হার বাড়ছে।

তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে বর্তমানে সবচেয়ে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এছাড়া অন্যান্য প্রায় সব হাসপাতালেই শয্যা ফাঁকা রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, কয়েকটি এলাকায় এখনও ডেঙ্গু সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে অন্যতম হলো- যাত্রাবাড়ী, মুগদা, উত্তরা, জুরাইন ও মিরপুর। এসব এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী যাত্রাবাড়ী এলাকায়। বিভাগীয় পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, আক্রান্তের দিক থেকে ঢাকার পরেই চট্টগ্রামের অবস্থান।

সারাদেশে এডিস মশা মারতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব কঠিন হবে বলেও জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, শুধু ঢাকা নয়, ডেঙ্গু যতটা মেডিকেল প্রবলেম, তার থেকে বেশি এনভায়রনমেন্টাল প্রবলেম। এক্ষেত্রে পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং বেশি জরুরি।

পাল্টেছে ধরন, প্রাদুর্ভাব আরও বাড়ার আশঙ্ক
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জাহিদুর রহমান আজ রবিবার (৬ আগস্ট) সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার এখন ঊর্ধ্বমুখী। আগস্ট মাসে এই প্রকোপ আরও বাড়তে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারাবিশ্বেই হঠাৎ তাপদাহ বা অতিবৃষ্টি হচ্ছে। তাই সারাবছরই ডেঙ্গু থাকবে। তবে বর্ষার শুরু এবং শেষে এর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি থাকবে। সেই অর্থে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার শঙ্কা থেকেই যায়। 

একই ধরনের শঙ্কার কথা জানিয়েছেন হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি মনে করেন,  চলতি আগস্ট ও আগামী সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব আরও বেড়ে যাবে।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি সম্পর্কে ডা. লেলিন চৌধুরী জানিয়েছেন, যেভাবেই হোক বর্তমানে ডেঙ্গু রোগের লক্ষণগুলো বেশ বদলে গিয়েছে। এবছর ডেঙ্গুর যে প্রকার দেখা যাচ্ছে, সেগুলো সেকেন্ডারি ফর্মের। অর্থাৎ আগে যিনি ডেঙ্গুর অন্য কোনো উপধরন দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি এখন আরেকটি ধরণ বা উপধরণ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বার যখন কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় তখন মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এবারে তাই হচ্ছে।

মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যায় রেকর্ড: ডেঙ্গু কি মহামারিতে রুপ নিচ্ছে
চলতি বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গু যে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে তা ২০১৯ সালে হয়ে যাওয়া মারাত্মক ডেঙ্গু পরিস্থিতির চেয়েও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এবছর মোট মৃত্যু তিনশ ছাড়িয়ে গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ৫ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৩০৩ জন মারা গেছেন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৯৩৩৪ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ভর্তি ৪৬৮০ জন। অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৪৬৫৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে এখন পর্যন্ত ৬৩ হাজার ৯৬৮ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।

গত সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কতা জানিয়ে বলেছে, ডেঙ্গু ফিরছে মহামারী রূপে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস আজেপ্তাই জাতীয় মশার বংশবৃদ্ধি হচ্ছে দ্রুত বলে দাবি সংস্থাটির।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, গতবছর ১২৯টি দেশে মোট প্রায় ৫২ লক্ষ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। চলতি বছরে ইতিমধ্যেই লাতিন আমেরিকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, পেরু, প্যারাগুয়েতে ডেঙ্গু ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে। করোনার মতোই ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে ডেঙ্গু- এমনটাই আশংকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার।

পরিস্থিতিকে আরও উসকে দিচ্ছে আবহাওয়া
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে পড়া বৃষ্টিতে মশা বেড়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা এর মধ্যে অনেক ডিম পেড়েছে। বৃষ্টির পানি পেয়ে ডিমগুলো থেকে লার্ভা বেরোবে। এতে আরো নতুন এডিস মশা জন্ম নেবে, যা ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটাতে পারে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার জানিয়েছেন, থেমে থেমে যে বৃষ্টিপাত হচ্ছে, এটি মশা প্রজননের জন্য আরো উপযোগী। সুতরাং অবনতি যে হচ্ছে, সেটা বলা যায়। ঢাকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে।

তিনি বলেন, এ মুহূর্তে মশা নিয়ন্ত্রণে জনসম্পৃক্ততা খুব প্রয়োজন। সমাজসেবামূলক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বাসাবাড়িতে যেসব স্থানে পানি জমে থাকে, সেখানে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

গৃহীত পদক্ষেপ কী আর বাস্তবায়নই বা কতটুকু
এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১০টি উপ-অঞ্চলে ভাগ করতে হবে এবং প্রতিটিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে কমিটি গঠন করতে হবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে তিন স্তরবিশিষ্ট কমিটি করা হলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এমন কোনো কমিটি হয়নি। অন্য ১০টি সিটি করপোরেশনেও এ ধরনের কোনো কমিটি গঠিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। 

গত বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা মন্ত্রী তাজুল ইসলামের কাছে জানতে চান ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু বা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যক্রম আদৌ আছে কি না, সেটার দায়িত্ব কার? জবাবে মন্ত্রী বলেন, এডিস মশা সারাদেশে বিস্তার লাভ করতে পারে, এরকম একটা আশঙ্কা থেকেই আমরা ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন তৈরি করেছি মন্ত্রণালয় থেকে। স্থানীয় সরকারের যতগুলো প্রতিষ্ঠান আছে-ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনসহ সব প্রতিষ্ঠানকে তাদের দায়িত্ব বিভাজন করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা যেন দায়িত্ব পালন করে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই। নারায়ণগঞ্জ ও রংপুর সিটি করপোরেশনে একজন করে কীটতত্ত্ববিদ আছেন। দেশের বাকি আট সিটি করপোরেশনে অর্থাৎ খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা, গাজীপুর, সিলেট ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই।

মশা মারতে আজ থেকে বিটিআই নিয়ে মাঠে নামছে ডিএনসিসি
ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এডিস মশা মারতে আজ রবিবার (০৬ আগস্ট) থেকে নতুন কীটনাশক বিটিআই প্রয়োগ শুরু করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। ডিএনসিসি জানিয়েছে, এই কীটনাশকের পুরো নাম বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস। ২৫ গ্রামের এক প্যাকেট বিটিআই ১০ লিটার পানিতে ২৫ থেকে ৫০ বর্গমিটার এলাকায় ছিটাতে হয়।

প্রাথমিকভাবে ঢাকার সড়কের পাশের নালায় এই ওষুধ ছিটানো হবে বলে জানিয়েছে ডিএনসিসি। মশা নিধনে এই কীটনাশক কতটা কার্যকর? এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার জানান, গবেষণাগারে আমরা মশা মারতে এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করেছি। এতে খুব ভালো ফল পাওয়া গেছে। বিভিন্ন দেশে গবেষকরা ল্যাবরেটরি ও মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এটিকে মশার লার্ভা দমনে কার্যকর উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

ভ্যাকসিন প্রয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি
এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর সংক্রমণরোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এটি সরকারের বিবেচনাধীন বিষয় বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ।

গতকাল শনিবার বিএসএমএমইউর কনফারেন্স রুমে `ডেঙ্গুবিরোধী সামাজিক আন্দোলন চাই' শীর্ষক আলোচনা সভায় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে এটি স্ট্রেইন নির্ভর। যেহেতু ডেঙ্গুর একাধিক স্ট্রেইন একটিভ রয়েছে। ফলে কোনটা কার্যকর হবে সেটি গবেষণা প্রয়োজন। বিএসএমএমইউতে ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের ব্যাপারে গবেষণা করে তৈরি করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগকে দ্রুত কাজ শুরু করার জন্য নির্দেশ দেন। জ্বর হলে ঘরে বসে না থেকে দ্রুত এনএসওয়ান টেস্ট করার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না। প্রচুর তরল খাবার খেতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫