
ফাইল ছবি
বিধি-বিধান অনুযায়ী পদোন্নতি কিংবা বদলির ক্ষেত্রে তদবির অপরাধ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে
তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
পদোন্নতি বা ভালো পদে
পদায়নের ক্ষেত্রে তদবিরকেই মনে করা হচ্ছে
সবচেয়ে বড় নিয়ামক। চাকরির
মেয়াদ শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ
পেতেও তদবির করা হচ্ছে।
শেষ
সময়ে এসে কর্মকর্তাদের নিজেদের
অনুকূলে রাখতে দফায় দফায় পদোন্নতির
উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কর্মকর্তারাও পদোন্নতির তালিকায় নিজের নাম রাখতে তদবিরে
মরিয়া। নিজের পক্ষে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের
আধা-সরকারি পত্র (ডিও) নিয়ে জমা
দিচ্ছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। এমনকি টেলিফোনও করাচ্ছেন। তাই শেষ মুহূর্তে
কর্মকর্তাদের মরিয়া তদবিরের চাপে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
তবে
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা
জানিয়েছেন, এটা প্রশাসন রাজনীতিকীকরণের
ফল। বিধিমালায় কর্মকর্তাদের তদবির নিষিদ্ধ হলেও তদবিরকারী কর্মকর্তাদের
বিরুদ্ধে কখনো ব্যবস্থা নিতে
শোনা যায়নি। গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে তদবির আসলে
জনপ্রশাসন তা না রেখে
পারে না। তাই অনেকে
তদবির করে লক্ষ্যে পৌঁছে
যাচ্ছেন। এতে সৎ, দক্ষ
ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা হতোদ্যম হয়ে পড়ছেন। প্রশাসনের
শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে, কর্মকর্তাদের
মর্যাদা নষ্ট হচ্ছে। তাই
প্রশাসনের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে এ ধারা থেকে
বের হতে হবে। যারা
তদবির করবেন সেই কর্মকর্তাদের বিধি-বিধান অনুযায়ী শাস্তির আওতায় আনতে হবে এরপর
অতিরিক্ত সচিব ও উপসচিব
পদেও পদোন্নতি আসতে পারে বলে
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে।
একই
আইনে তদবির করার জন্য সংসদ
সদস্যদের কাছে যাওয়ার ওপরও
নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। কোনো কর্মকর্তা এ
বিধান লঙ্ঘন করলে সরকারি কর্মচারী
(শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা
অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে বলেও
বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৫৮
সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জারি
করা এক স্মারকেও কোনো
সরকারি কর্মচারী তার চাকরি-সংক্রান্ত
বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য কোনো
মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের
কাছে তদবির করতে পারবেন না
বলে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
তদবির
করা চাকরিবিধির লঙ্ঘন হলেও অতীতেও সরকারি
কর্মকর্তারা রাজনৈতিক তদবিরের মাধ্যমে পদোন্নতি, চুক্তি ও পদায়ন নিয়েছেন।
এ অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না
নেওয়ায় এই রেওয়াজের ধারাবাহিকতা
চলছে। এ কারণে প্রশাসনের
ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধা
কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম মাহাবুবুর
রহমানকে সচিব পদে পদোন্নতি
দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে আধা-সরকারি পত্র
(ডিও লেটার) দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম
মোজাম্মেল হক এবং একই
মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য শাজাহান খান।
জাতীয়
মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের বাস্তবায়নাধীন ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
বাস্তবায়ন’ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (উপসচিব) মো. নুরুল আমিনকে
যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দিতে
সুপারিশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম
মোজাম্মেল হক। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক
মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কামরুন নাহারকে
গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি
দিতেও সুপারিশ করে ডিও লেটার
দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী।
তথ্য
মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. সাইফুল ইসলামকে
যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দিতে
সুপারিশ করেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর
রাজ্জাক। শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন
তার মন্ত্রণালয়ে কর্মরত উপসচিব পদে কর্মরত মো.
মোমিনুর রশীদকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার
জন্য জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করেছেন।
তথ্য
ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের
ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিমকে গ্রেড-১ পদে পদোন্নতির
জন্য সুপারিশ করেছেন। চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের এমপি
সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার (ছেলুন)
শিল্প মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে কর্মরত মো. মনিরুজ্জামানকে যুগ্মসচিব
করার জন্য জোর সুপারিশ
করেছেন।
তদবিরের
তালিকায় বদলি আদেশ বাতিলের
সুপারিশও আছে। প্রাথমিক ও
গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মোশাররফ
হোসেনকে সম্প্রতি অন্য জায়গায় বদলি
করা হয়। এই আদেশ
বাতিলের জন্য সুপারিশ করেছেন
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী
মো. জাকির হোসেন।
উপসচিব
মো. আব্দুল আখেরকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দিতে
যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী
মো. জাহিদ আহসান রাসেল ডিও লেটার দিয়েছেন
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রঞ্জিত কুমার
দাসকে গ্রেড-১ পদে পদোন্নতি
দিতে সুপারিশ করেছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম
দস্তগীর গাজী।
এমনও
দেখা গেছে, দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের শাস্তির সুপারিশ না করে উল্টো
কোনো কোনো মন্ত্রী পদোন্নতির
সুপারিশ করেছেন। তখনকার রেলের পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী মঞ্জুর-উল আলম চৌধুরীর
বিরুদ্ধে করোনা প্রতিরোধসামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতিতে সংশ্নিষ্টতা এবং রেলের ইঞ্জিন
কেনায় অনিয়মে জড়িত থাকলেও এ
কর্মকর্তার পদোন্নতির সুপারিশ করেছিলেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন।
আরেক
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ
হোসাইন ভূইঞা বলেন, কর্মকর্তাদের এমপি-মন্ত্রী কিংবা
সচিবের কাছে ডিও লেটারের
জন্য ধরনা দেওয়া স্পষ্টতই
বিধিমালার লঙ্ঘন। কারণ তারা নিজেদের
পদোন্নতি, পদায়ন কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তিগত
স্বার্থের জন্য কাউকে দিয়ে
সুপারিশ করাতে পারেন না।
সাবেক
সচিব আবু আলম মো.
শহীদ খান বলেন, তদবির
ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পদোন্নতি
ও পদায়নের জন্য ডিও লেটারের
মাধ্যমে সুপারিশ করানো যে অন্যায়, এটা
যে আইনসিদ্ধ নয়, এটা সংশ্লিষ্ট
সরকারি কর্মচারীরাও জানেন। তবু এই অনিয়মই
এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী
বলেন, যদি কোনো কর্মকর্তার
পক্ষে মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীরা ডিও
লেটার দেন, তাহলে সেটা
সংরক্ষণ করা হয়। তাই
বলে সেটি কার্যকর হবে
এমন বাধ্যবাধকতা নেই।
জনপ্রশাসন
মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্
উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এ বিষয়ে সরাসরি
কিছু বলা আমার পক্ষে
সম্ভব নয়। এসব বিষয়ে
তথ্য-পরিসংখ্যানও আমার কাছে নেই।