
ইলিশ। ছবি: সংগৃহীত
ইলিশের
প্রচলিত ভরা মৌসুম জুন
থেকে আগস্ট। আগস্টে এসে সাগরে ঝিলিক
দিচ্ছে রুপালি মাছ। কিন্তু নদ-নদীতে মিলছে না আশানুরূপ ইলিশ।
তবে বিশেষজ্ঞরা শোনাচ্ছেন আশার বাণী। চলতি
আগস্টের শেষ দিকে ইলিশের
খরা কাটার আশা তাদের। সরকার
বলছে, চলতি বছর ইলিশের
উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে সাড়ে পাঁচ
লাখ টন। তবে ভবিষ্যতে
ঠিকমতো জাটকা সংরক্ষণ করা গেলে উৎপাদন
৭ লাখ ২০ হাজার
টনে উন্নীত করা সম্ভব। অবশ্য
সরকার এখন আর জাটকা
সংরক্ষণের ওপর নির্ভর না
করে ইলিশের ওপর গবেষণা বাড়াতে
চায়। ইলিশের বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানো, নানা পণ্য উৎপাদন,
কাঁটামুক্ত ইলিশের নতুন নতুন প্রযুক্তি
উদ্ভাবন এবং কৃত্রিম প্রজননে
গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এছাড়া নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের চাল
ও অর্থ সহায়তা ছাড়াও
বিকল্প কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য গত বছরের ৩১
জানুয়ারি থেকে দেশের ২৯টি
জেলার ১৩৪টি উপজেলায় ২৪৬ কোটি টাকা
ব্যয়ে ‘ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন
ও ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক চার বছর মেয়াদি
প্রকল্প পরিচালনা করছে মৎস্য ও
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের আর্থিক সহযোগিতায় টানা দুই বছর
ইলিশের সঠিক প্রজনন সময়
নির্ধারণ, বংশ বৃদ্ধির পরিবেশ
সৃষ্টি এবং সংরক্ষণ নিয়ে
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়ামিন হোসেন
গবেষণা করেন। সম্প্রতি শেষ হওয়া ওই
গবেষণায় বলা হয়, মা
ইলিশদের যদি ডিম দেওয়ার
পরিপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া যায়
তাহলে ২০০ গ্রামের একটি
ইলিশ মাছ থেকে প্রায়
দেড় লাখ ইলিশের বাচ্চা
পাওয়া যাবে। পদ্মা নদীর ইলিশ নিয়ে
গবেষণা করে দেখা গেছে,
১৪০০ গ্রামের একটি ইলিশ যদি
ডিম দেওয়ার সুযোগ পায় তাহলে প্রায়
১৬ লাখ ইলিশের বাচ্চা
হবে। যদি আর্থিক লাভের
কথা চিন্তা করা হয় তাহলে
একটি মাত্র ইলিশ থেকে ৭৬
লাখ থেকে ১ কোটি
টাকা আয় হবে।
অধ্যাপক
ড. ইয়ামিন হোসেন বলেন, গত ২০২০ সালে
ইলিশ আহরণের নিষিদ্ধকাল শুরু হয়েছিল ১৪
অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর
পর্যন্ত। কিন্তু পদ্মায় মা ইলিশ প্রবেশ
করেছিল ২০ নভেম্বরের পর।
মেঘনার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে সময়
শুরুর ৪-৫ দিন
পর মা ইলিশ ডিম
দেওয়ার জন্য প্রবেশ করেছে।
আবার ইলিশ আহরণের নিষিদ্ধকাল
শেষ হওয়ার পরও এসব নদীতে
মা ইলিশের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সুতরাং ইলিশ সম্পদকে রক্ষা
করার জন্য যে ২২
দিন ইলিশ আহরণের নিষিদ্ধকাল
নির্ধারণ করা হয় এই
সময় নিয়ে আমাদের নতুন
করে ভাবতে হবে।
এদিকে
পানিতে ইলিশের জন্য সুখবর পাওয়া
গেছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের
পানির মান পরীক্ষায়। এ
প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা গত জুন মাসেই
পানিতে দ্রবীভূত অপিজেন (ডিও-ডিসলভ অপিজেন),
পিএইচ, হার্ডনেস (ক্ষারত্ব), অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ইত্যাদি দেখেছেন। গবেষকেরা দেখেছেন, নদীর যেসব স্থানে
ইলিশের বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র, সেখানে
পানির গুণগত মান আগের চেয়ে
ভালো। এসব স্থানে এসে
ইলিশ স্বস্তি পাবে। পানির মান ভালো হওয়ার
জন্য এখানে মিলবে ইলিশের জন্য পর্যাপ্ত খাবার।
তাতে ইলিশের স্বাদ বাড়বে, বাড়তে পারে সংখ্যাও। বাড়বে
প্রজনন সফলতাও। গত বছর প্রজনন
সফলতা বলে জানিয়েছেন প্রশাসন
বিশেষজ্ঞরা।
চলতি
মাসের মধ্যেই হবে যুগ্মসচিব পদে
পদোন্নতি। ৫১ শতাংশ ছিল।
আগের বছর এটি ছিল
প্রায় ৪৯ শতাংশ। এবার
এ হার আরও বাড়বে
বলেই ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
মৎস্য
ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শুধু
উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, ইলিশ বাংলাদেশের
ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য
হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ২০১৭ সালের ১৭
আগস্ট। মাছটির ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য উৎপাদন কৌশল
উদ্ভাবন করা হয়েছে। ২০১৮
সালে ভারগো ফিশ অ্যান্ড অ্যাগ্রো
প্রসেস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে
ইলিশের স্যুপ ও নুডলস তৈরির
প্রযুক্তি হস্তান্তর করে মৎস্য অধিদপ্তর।
মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ শাখার উপপ্রধান
মাসুদা আরা মমি বলেন,
বর্তমান প্রজন্ম কাঁটাযুক্ত মাছ খেতে চায়
না। কিন্তু বেড়ে ওঠার জন্য
মাছ তো দরকার। সেই
চিন্তা থেকেই কাঁটা ছাড়া মাছ খাওয়ার
বিষয়টি এসেছে। সেখান থেকে বিজ্ঞানীরা কাঁটা
ছাড়িয়ে ইলিশের স্যুপ ও নুডলস তৈরি
করেছিলেন। কিন্তু যে কোম্পানিকে আমরা
এ প্রযুক্তি হস্তান্তর করেছি তারা নানা জটিলতায়
এটি বাজারজাত করতে পারেনি। এখনো
কেউ চাইলে আমাদের কাছ থেকে এ
প্রযুক্তি নিতে পারে।
তবে
সম্প্রতি মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ইলিশের চিপস ও ফিশ
বল তৈরি করেছে। মৎস্য
গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, এ দুটি পণ্য
বাজারজাতের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এখন প্যাকেজিংয়ের
কাজ চলছে, তারপর আমরা যে কোনো
কোম্পানিকে এটি দিতে পারব।
ইলিশ থেকে মূল্য সংযোজিত
আরও পণ্য উৎপাদনে আমরা
গবেষণা করছি।
ইলিশের
কৃত্রিম প্রজননে কাজ করছে বাংলাদেশ
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। ১৯৮৮ সালে সরকারি
অর্থায়নে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদী কেন্দ্র, চাঁদপুরের
দুটি পুকুরে ইলিশ চাষের প্রথম
উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সে
সময় ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৯৫ সালে সেই
প্রকল্প বাতিল করা হয়। এরপর
২০০৪-০৫ অর্থবছরে পুকুরে
ইলিশ চাষ বিষয়ে গবেষণা
হয়। কিন্তু তখনো তেমন সফলতা
আসেনি। এরপর ২০১০-১১
এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে
‘জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও গবেষণা’ প্রকল্পের
অধীনে গবেষণা শুরু হয়। তখন
গবেষণার জন্য নদী-সাগর
থেকে ৮-১২ সেন্টিমিটার
সাইজের ২ হাজার ২০০
ইলিশের পোনা সংগ্রহ করে
ইনস্টিটিউটের ৩টি পুকুরে ছাড়া
হয়। এর এক বছর
পর মাছগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায়,
মাছের বৃদ্ধির হার খুবই কম।
ডিমগুলোও অপরিপক্ব। পরবর্তী সময়ে ২০১৫-১৬
সালে ওয়ার্ল্ড ফিশ সংস্থার ইকোফিশ
প্রকল্পের অধীনে ইউএসএইডের অর্থায়নে আবারও গবেষণা শুরু হয়। কিন্তু
সেটিও সফল হয়নি।
পুকুরে
ইলিশ চাষের সম্ভাবনা বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইলিশ গবেষক ড.
আনিছুর রহমান বলেন, পুকুরের চাষ করা ইলিশ
প্রাকৃতিক খাবার খায়। এছাড়া বদ্ধ
জলাশয়ে খাদ্য ও পানির গুণাগুণ
ধরে রাখা খুব কঠিন।
ওই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তী
সময়ের গবেষণায় পুকুরের ইলিশগুলোকে প্রাকৃতিক খাবার তৈরি করে দিয়ে
দেখেছি। এর ফলে আগের
চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও তা
বাণিজ্যিকভাবে চাষ করার মতো
নয়। বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে হলে
আরও ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবে পুকুরে ইলিশ
চাষ একেবারেই অসম্ভব নয়।
এবিষয়ে
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ইলিশের কৃত্রিম প্রজনন খুবই স্পর্শকাতর। তার
পরও আমারা চেষ্টা করছি। সর্বশেষ আমরা কৃত্রিম প্রজননের
জন্য অন বোট ব্লিডিং
পদ্ধতি ব্যবহার করছি। জাহাজের মধ্যেই মিনি হ্যাচারি তৈরি
করে অক্টোবর-সেপ্টেম্বরে প্রজনন মৌসুমে সাগর থেকে মেল
ও ফিমেল ইলিশ রাখছি। ইতোমধ্যে
কৃত্রিম প্রজননের ফার্টিলাইজেশন হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা
পোনা উৎপাদনের চেষ্টা করছি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ইলিশ রক্ষায় সরকার এ পর্যন্ত যে কটি পদক্ষেপ নিয়েছে, তার প্রতিটি বিজ্ঞানসম্মতভাবে নেওয়া হয়েছে। আর এর বাস্তবায়নও বেশ কঠোরভাবে করা হয়েছে। এর সুফল পাওয়া গেছে। গবেষণায় ইলিশের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচনে চেষ্টা করে যাচ্ছি।