Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

অপরিকল্পিত উন্নয়ন

টাকা যায় জলে, দুর্ভোগ পোহায় মানুষ

Icon

আহমেদ সেলিম

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:৪০

টাকা যায় জলে, দুর্ভোগ পোহায় মানুষ

ফাইল ছবি

চট্টগ্রাম নগরকে জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচাতে ৩ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে আউটার রিং রোড। এই প্রকল্পে আছে ১১টি স্লুইসগেট। কিন্তু খালের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ নেই এগুলোর। এটি নগরের একাংশে জলাবদ্ধতা তৈরি করতে পারে বলে ২০১৮ সালে প্রকল্পটির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে আসে। কিন্তু সে প্রতিবেদন উপেক্ষা করে এখন বাস্তবায়ন হচ্ছে রিং রোড প্রকল্প। তাই সামান্য বৃষ্টিতেই এখন জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রামের একাংশে। চলতি বছরের ৭ মাসে চট্টগ্রাম শহর ডুবেছে ১০ বার। ডুবে যাচ্ছে কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলার বিস্তীর্ণ ভূমি। ফলে পুরো টাকাই নষ্ট হবে বলে দাবি স্থানীয়দের। 

এভাবেই খুলনার ডুমুরিয়ার বুক চিরে বয়ে চলা ভদ্রা ও সালতা নদীর অপরিকল্পিত খননে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৪৬ কোটি টাকাই জলে যায়। খননের সময়ে নদীর জোয়ার ভাটার প্রতিবন্ধকতা অপসারণ না করায় মাত্র দেড় বছরের মাথায় নদী দুটি ভরাট হতে শুরু করে। বর্তমানে যার অধিকাংশ স্থান মরা খালে পরিণত হয়েছে। কোথাও আবার রীতিমতো চাষাবাদ হচ্ছে। বিলের চেয়ে নদীর তলদেশ উঁচু হওয়ায় বিলের পানি নিষ্কাশনের সুযোগ কমে গেছে। ফলে নতুন করে দুর্ভোগে পড়েছে এলাকাবাসী। শঙ্কা রয়েছে আগামীতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার। 

চট্টগ্রাম নগর আর খুলনার ডুমুরিয়ার মতো অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন তৈরির কারণে ভূতাত্ত্বিকভাবে রাজধানী ঢাকাও রয়েছে ‘মাঝারি’ ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে। বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি রাজধানীর প্রায় ৩০০০ ভবনের ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়ে ৪২টি ভবনকে অতিমাত্রায় ঝুঁকিতে থাকার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব ভবন ভেঙে ফেলার সুপারিশ করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। 

চট্টগ্রাম, খুলনা আর ঢাকার মতো সারাদেশে নানা অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে বছরে গচ্চা যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। আর এসব অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় লাখ লাখ মানুষকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো প্রকল্প হাতে নিলে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দীর্ঘ মেয়াদে কী উপকার হবে আর কী দুর্ভোগ পোহাতে হবে তা যাচাই করা হয় না। এক শ্রেণির কর্মকর্তারা মনে করেন একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তাদেরও কিছু লাভ হবে। তাই যাচাই-বাছাই না করেই হাতে নেন প্রকল্প। এতে ওই প্রকল্পে কোনো সুবিধা ভোগ করার চেয়ে উল্টো দুর্ভোগ পোহাতে হয় জনগণকে। আর সরকারের লাখ লাখ কোটি টাকা জলে যায়। তাই কোনো উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিলে দফায় দফায় যাচাই করার সুপারিশ করেন তারা। 

অপরিকল্পিত প্রকল্প উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে বলে মনে করেন খোদ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় মন্ত্রী তাজুল ইসলামও। সম্প্রতি তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প নিয়ে অবকাঠামোসহ যে কোনো উন্নয়ন কাজ করলে যেমন তা টেকসই হয় না তেমনি উন্নয়নের সুফল মানুষের নিকট পৌঁছানো যায় না। বরং সুফলের চেয়ে কুফল বয়ে আসে। তাই সকল উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার আগে তার ফিজিবিলিটি স্টাডি করে গ্রহণ করতে হবে।

প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে ফিজিবিলিটি স্টাডির গুরুত্ব তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, এনভায়রনমেন্টাল, জিওলজিক্যাল, হাইড্রোলোজিক্যাল, সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট, ডেমোগ্রাফিক সাইজ এবং ইকোনমিক আউটপুট বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্প নিতে হবে। এসব বিষয়ে স্টাডি না করে প্রকল্প নেওয়া যাবে না। নিলে সুফল মিলবে না।

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত জানান, আগে পানির গতিপথে প্রতিবন্ধকতা ছিল না। বেশি বৃষ্টি হলেও পানি ভাটিতে নেমে যেত। এখন অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে পানির পথে বাধা তৈরি হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে বাড়ছে বন্যার ঝুঁকি। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনও একই রকম ঝুঁকি তৈরি করেছে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। স্থানীয়রা রেললাইনের কারণে বন্যার যে ভয়াবহতার কথা বলছেন, সেটাই সঠিক। রেললাইন আটকে দিয়েছে পানি। আগে পানি আটকাত না, তাই এমন বন্যাও হয়নি। এর পুরোটাই প্রকৌশল ও নকশার ব্যর্থতা। বড় প্রকল্প নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্টদের পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অন্যদিকে ২০১৮ সালের ৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুলনার সার্কিট হাউস মাঠে এক জনসভায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রা নদী খনন কাজের উদ্বোধন করেন। যা পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১৯ সালের ৩০ জুন ভদ্রা-সালতা খনন প্রকল্প নামের ওই প্রকল্পের মাধ্যমে ভদ্রা নদীর ২১ কিলোমিটার ও সালতা নদীর নয় কিলোমিটার খননকাজ শেষ করে।

৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পে কথা ছিল নদী ১২০ ফুট চওড়া আর ১৬ ফুট গভীর করা হবে। এতে করে জলাবদ্ধতা নিরসন ও সেচ কাজের সুবিধার স্বপ্ন দেখেছিলেন সদর, শোভনা, খর্ণিয়া, রঘুনাথপুর, রুদাঘরা ও রংপুর ইউনিয়নের ৫৫টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ।

গ্রামবাসীর অভিযোগ, কোনো নিয়মনীতি অনুসরণ না করে নদী খনন করা হয়েছিল। নদী থেকে মাটি উত্তোলন করে দুই পাড়ে রেখে দেওয়ায় বর্ষা মৌসুমে মাটি ধুয়ে আবার তা নদীতে গিয়ে পড়ে। ফলে এক বছরের মধ্যে জোয়ার-ভাটায় নদী পুনরায় ভরাট হয়ে গেলে ভেস্তে গেছে সব স্বপ্ন। স্থানীয়রা জানায়, পাউবো ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হঠকারী সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার অভাব ছিল।

এ বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ জানান, ভদ্রা ও সালতা নদী খনন করার সময় জোয়ার ভাটার পানি প্রবাহের কথা মাথায় রাখা হয়নি। গাবতলা এলাকায় নদীর মধ্যে বাঁধ রেখে নদী খনন করা হয়। এটাই ছিল কাল। সে কারণে সেখানে একটি সেতু তৈরি হলে এই অবস্থা হতো না। এ ছাড়া নদী খননের জন্য সার্বক্ষণিক একটি ড্রেজার মেশিন রাখতে বলা হয়েছিল, সেটিও কর্তৃপক্ষ রাখেনি।

অপরিকল্পিত উন্নয়ন হচ্ছে খোদ রাজধানীতেও। এমনিতে ভূতাত্ত্বিকভাবে রাজধানী ঢাকা ‘মাঝারি’ ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে। তার ওপর অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন তৈরির কারণে ঢাকায় বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পাশাপাশি ২০০০ সালের পর থেকে গড়ে ওঠা নতুন আবাসিক এলাকাগুলো ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে। বিশেষ করে পুরান ঢাকায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে গড়ে ওঠা ভবন বা বসিলা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, বনশ্রী, আফতাবনগরসহ এসব এলাকা জলাশয়, জলাভূমি ভরাট করে বালি বা কাদামাটির ওপর করা হয়েছে। যার কারণে এসব এলাকা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।

সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার ২০০৯ সালে এক যৌথ জরিপ থেকে জানা যায়, ঢাকায় ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে; ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরপর কেটে গেছে ১৪ বছর। এই সময়ে নিয়ম না মেনে গড়ে তোলা ভবনের সংখ্যা বেড়েছে। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এতে আরও বাড়বে। 

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স বরাবরই বলে আসছে যে, ঢাকা শহরের ৭৬ শতাংশ রাস্তা সরু হওয়ায় ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে যাবে। এছাড়া ৬০ শতাংশ ভবন মূল নকশা পরিবর্তন করে গড়ে ওঠায় বড় ধরনের ভূমিকম্পের সময় এই অপরিকল্পিত ভবনগুলো সঙ্গে সঙ্গে ধসে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পরিকল্পিত নগরায়ণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আফসানা হক বলেন, উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় নগরায়ণ হবেই। তবে অপরিকল্পিত কোনো কিছুই ভালো না। অপরিকল্পিত নগরায়ণের অসুবিধা আমরা ঢাকা শহরে যারা বাস করছি, তারা কিছুটা হলেও ভোগ করছি। তার মতে, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে রাস্তাঘাটে চলাচলের অসুবিধা, বাসাবাড়িতে থাকার অসুবিধার পাশাপাশি গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততা, শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা পাওয়াও বাধাগ্রস্ত হয়।

নগরায়ণের অসুবিধা দূর করে সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে কোন বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া দরকার- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটির দ্রুত কোনো সমাধান নেই। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ারও অনেক ধাপ আছে। এটির জন্য তিনটি লেভেলে পরিকল্পনা প্রয়োজন। পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য একটি জাতীয় পরিকল্পনা থাকতে হবে, যেখানে পলিসি গাইডলাইন থাকবে। এরপর রিজিওনাল লেভেলের পরিকল্পনা, যেটি বিভাগভিত্তিক হতে পারে। আর এই পরিকল্পনা অবশ্যই জাতীয় পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই করতে হবে। সবশেষ রিজিওনাল লেভেলের পরিকল্পনার আওতায় লোকাল লেভেলের পরিকল্পনা প্রয়োজন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫