ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ
কাজে আসেনি শত কোটি টাকার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা

প্রতীক সিফাত
প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৩, ১২:১০

ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকার গুলশান-১ লিংক রোড ইন্টারসেকশনে স্থাপন করা হয় স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বসানো হয়েছিল সৌর প্যানেল। গুলশান-১-এর ওই ইন্টারসেকশনে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটি এখন আর কার্যকর নেই। একইভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে রয়েছে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থাটিও। সনাতন পদ্ধতির হাতের ইশারাতেই ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে সিগন্যালটিতে।
স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও সৌর বিদ্যুৎ স্থাপন করা হয়েছিল উত্তরার হাউস বিল্ডিং কলোনি ইন্টারসেকশন, শংকরের সাত মসজিদ রোড ইন্টারসেকশন, জসীম উদ্দীন রোড ইন্টারসেকশ, বনানীর ১১ নম্বর রোডের ইন্টারসেকশন, গুলশান-২ নম্বরসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ইন্টারসেকশনেও। এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কেবল গুলশান-২ নম্বর ইন্টারসেকশনটিতে চালু আছে। সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আর কোথাও কার্যকর নেই।
পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ঢাকার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে স্থাপিত স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা কোনো কাজে আসেনি। অপচয় হয়েছে এ খাতে ব্যয় হওয়া প্রায় ১০০ কোটি টাকা। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেগুলো বিবেচনা না করায় সিগন্যাল বাতিগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ট্রাফিক সিগন্যাল সরবরাহ ও স্থাপন এবং টিসিডি উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, রিমোট কন্ট্রোল সরবরাহ ও চালু, মেটাল বক্স সরবরাহ ও চালু করতে খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে ২১ কোটি টাকা। ২৩টি ইন্টারসেকশনের উন্নতি করতে খরচ হয়েছে ২৭ কোটি টাকার বেশি। ৭৩টি ইন্টারসেকশনের অবকাঠামো উন্নয়ন, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচর্যায় খরচ হয়েছে ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সিটি ট্রাফিক ব্যবস্থার জন্য ওয়্যারহাউস নির্মাণের জন্য খরচ হয়েছে ৫ কোটি টাকা। ১৮ ইউনিট সোলার প্যানেল কিনতে খরচ হয়েছে দুই কোটি টাকা। ট্রাফিক সিগন্যালে সোলার প্যানেল, টিসিডি সরবরাহ ও স্থাপন করতে ব্যয় হয়েছে ১৬ কোটি টাকা। ট্রাফিক সিগন্যালগুলো উন্নয়নের জন্য পরামর্শক বাবদ খরচ হয়েছে ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য খরচ হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় ট্রাফিক সিগন্যাল নির্মাণ, স্বয়ংক্রিয় রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম ও ট্রাফিক সিগন্যালে সোলার প্যানেল সিস্টেম চালু করা হলেও প্রায় সব ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশ হাত দিয়ে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করছেন। স্থাপিত ট্রাফিক সিগন্যাল, স্বয়ংক্রিয় রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম ও সোলার প্যানেল অকার্যকর ও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রকল্পের আওতায় যাত্রী ছাউনি নির্মিত হলেও কিছু কিছু স্থানে এসব ছাউনির ভেতরে গড়ে উঠেছে দোকান। ফলে সেগুলো আর যাত্রী ছাউনি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৮৮টি ইন্টারসেকশনে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রকল্পটি যখন শেষ হয়, তখন এ ব্যবস্থা সচল ছিল। বর্তমানে এই সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে এর বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের পরিমাণ আশানুরূপ নয়। ঢাকা মহানগরীর বাতাসে অতিরিক্ত পরিমাণ ধুলাবালি ও আর্দ্রতা থাকায় সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা কার্যকর রাখার ক্ষেত্রে ঘন ঘন রক্ষণাবেক্ষণে অধিক ব্যয় হয়। যার ফলে এ ব্যবস্থা সচল রাখা কষ্টসাধ্য। ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকার সব ট্রাফিক সিগন্যাল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগ। তাদের কাছেই এ বিষয়ে সব তথ্য রয়েছে। তবে বর্তমানে কোনো স্থানে ইন্টারসেকশন রিমোট কন্ট্রোল সিগন্যালিং ব্যবস্থা কার্যকর নেই। তাছাড়া রিমোট কন্ট্রোল সিগন্যালিং ব্যবস্থা চালুর ফলে তেমন কোনো সুবিধা হয়নি বলেও অভিমত প্রকাশ করেন তারা।
রাজধানীতে স্থাপিত সিগন্যাল ব্যবস্থা অকার্যকর থাকার জন্য সিগন্যাল বাতিগুলো যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করাকে দায়ী করছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও ট্রাফিক বিভাগের প্রধান মুনিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ এবং সিগন্যাল ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য ট্রাফিক বিভাগের সক্ষমতার কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু আমরা যে সিগন্যাল বাতিগুলো ব্যবহার করব তার জন্য সেগুলো কার্যকর থাকতে হবে। এসব বাতি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তাছাড়া একটি সংস্থা সিগন্যাল বাতির রক্ষণাবেক্ষণ করবে, আরেকটি সংস্থা সেগুলো পরিচালনা করবে- এমন হলে কিন্তু সেগুলো যথাযথভাবে কার্যকর রাখার কাজটি কঠিন হয়ে যায়।’ এসব দায়িত্ব একটি সংস্থার হাতে থাকলে সিগন্যাল ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা সহজ হয়ে যেত বলে মনে করেন ট্রাফিক বিভাগের প্রধান।
সিগন্যাল বাতি স্থাপনের প্রকল্পগুলোতে অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও ঢাকা শহরের মানুষের কোনো লাভ হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, ‘গত এক যুগের বেশি সময় ধরে ঢাকা শহরের সিগন্যালগুলো স্থাপন করা হয়েছে। তার কোনোটিই বিদ্যমান যানবাহনের পরিমাণ ও যানবাহনের গতি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। যারা এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে পরামর্শক ছিল, যারা বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ছিল, এ সম্পর্কে তাদের ধারণা আছে কিনা- আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ তারা যানবাহনের গতি ও ট্রাফিকের পরিমাণ বিবেচনা না করেই এগুলোর নকশা ও বাস্তবায়ন করেছে।’
ড. হাদিউজ্জামান আরও বলেন, ‘সিগন্যাল বাতি কিংবা সিগন্যাল ব্যবস্থা কার্যকরের জন্য কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে। প্রথমত যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন একসঙ্গে চলাচল বন্ধ করা। দ্বিতীয়ত পথচারীদের জন্য অবশ্যই ইন্টারসেকশনের চার কোনায় পর্যাপ্ত জায়গা রাখা। তৃতীয়ত ইন্টারসেকশন ঘেঁষে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন না রাখা। একটা শহরের ট্রাফিকের পরিমাণ যখন তার সক্ষমতার চেয়ে বেশি চলে যায়, তখন সিগন্যাল সেখানে কার্যকর হবে না। সিগন্যাল বাতি স্থাপনের আগে যদি ছোট করে হলেও সম্ভাব্যতা যাচাই করা হতো তাহলে প্রথমেই বের হয়ে আসত, এখানে সিগন্যাল কার্যকর হবে না।’