Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

কার স্বার্থে বিপুল ব্যয়ে নতুন লঞ্চ টার্মিনাল

Icon

প্রতীক সিফাত

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৫:৩৬

কার স্বার্থে বিপুল ব্যয়ে নতুন লঞ্চ টার্মিনাল

সদরঘাট। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার সঙ্গে বছর দুয়েক আগেও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল লঞ্চ। ঈদ-পার্বণে উপচেপড়া ভিড় লেগে যেত দেশের সর্ববৃহৎ নদীবন্দর রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। প্রায়ই ঘটত দুর্ঘটনা। প্রাণহানির ঘটনাও নেহাত কম ছিল না।

এমন পরিস্থিতিতে যাত্রীসেবা বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নতুন প্রকল্প হাতে নেয়। এর অধীনে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সদরঘাট থেকে এক কিলোমিটার দূরে পোস্তগোলার শ্মশানঘাটে আরেকটি লঞ্চ টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানানো হয়। পাশাপাশি চাঁদপুর, বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের অবকাঠামোও বড় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে যাত্রী সংখ্যা কমে যাওয়ায় নতুন টার্মিনাল নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

বিআইডব্লিউটিএ অবশ্য বলছে, নতুন বাস্তবতায় দ্বিতীয় টার্মিনাল নির্মাণ হলে সেটিকে যাত্রীবাহী এবং বর্তমান সদরঘাটটি পণ্যবাহী লঞ্চ টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার করা হবে। অন্যদিকে নৌসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, শুধু টার্মিনাল নির্মাণ একটি অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো হবে, যদি না ঘাট পর্যন্ত নির্বিঘ্নে যাত্রীদের পৌঁছার মতো অবকাঠামো নির্মাণ হয়। তবে কঠিন সংকটের সময়ে প্রকল্পটিকে বিলাসী আখ্যা দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাত্রী সংকটে যেখানে একের পর এক নৌপথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে নতুন নদীবন্দর নির্মাণ কিংবা সম্প্রসারণ সরকারি সম্পদের অপব্যবহার। তারা এ প্রকল্পের পরিবর্তে নদীপথ ড্রেজিংয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন।

জানা গেছে, সদরঘাটের পাশাপাশি দেশের গুরুত্বপূর্ণ আরও তিনটি নদীবন্দর- চাঁদপুর, বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জের অবকাঠামোও বড় করা হবে। এক দশক আগের হিসাব অনুযায়ী এ চার নদীবন্দরে ৫৩ মিলিয়ন টন মালবাহী এবং ২২ মিলিয়ন যাত্রীবাহী নৌযান ভেড়ে ও ছেড়ে যায়। ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও যাত্রীচাপের কারণেই এ চারটি বন্দরের বিদ্যমান অবকাঠামো ছিল অপ্রতুল। বিশেষ করে এসব বন্দর এলাকা অত্যন্ত যানজট ও জনাকীর্ণ। তাই যাত্রীসেবা বাড়ানোর লক্ষ্যে এ চার নদীবন্দরের অবকাঠামো বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিআইডব্লিউটিএ। 

বরিশাল দেশের অন্যতম নদীবন্দর। একসময় যাত্রীদের পদচারণায় মুখর ছিল। তখন প্রয়োজনীয় সংখ্যক পন্টুন না থাকলেও যাত্রীচাপ সামাল দিতে দৈনিক ৮-১২টি লঞ্চ চলাচল করত। তবে পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রী সংকটে বরিশাল-ঢাকা রুটে চলাচল করছে কেবল দুটি লঞ্চ। যে কারণে ফাঁকাই থেকে যাচ্ছে বন্দরের পন্টুনগুলো। এরপরও বন্দর আধুনিকায়নে ৯২ কোটি ৮০ লাখ টাকার বৃহৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।

লঞ্চ মালিক সমিতির সহসভাপতি সাঈদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘এক সময় বরিশাল নদীবন্দরে পন্টুন সংকটের কারণে লঞ্চ বাঁধতে নানা সমস্যায় পড়েছি। তখন কেউ আমাদের কথা শোনেনি। এখন তো যাত্রীই নেই, লঞ্চ বন্ধ করে দিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার চিন্তা করছি। এখন এত বড় প্রকল্প ও আধুনিকায়ন দিয়ে কী হবে?’ 

বরিশাল-ঢাকা নিয়মিত যাতায়াত করা যাত্রী রেজাউল করিম বলেন, ‘লঞ্চ মালিকদের কাছে এক সময় জিম্মি ছিল দক্ষিণাঞ্চলবাসী। পদ্মা সেতু চালুর পর সেই জিম্মিদশা থেকে যাত্রীরা রক্ষা পেয়েছে। এখন বরিশাল-ভোলা ও মুলাদীর মিরগঞ্জ সেতু নির্মাণ হলে নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। তাই নদীপথে যাত্রীসেবায় টিকে থাকতে লঞ্চগুলোকে সেবার মান বাড়ানোর পাশাপাশি ভাড়া কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’ 

বিআইডিব্লিউটিএর বরিশাল প্রকৌশল শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন উর রশীদ বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের এ প্রকল্পটি নতুন নয়, ২০১৬ সালের। প্রকল্পটি যখন নেওয়া হয় তখন বরিশাল নদীবন্দরের চিত্র একরকম ছিল, এ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা ছিল। পদ্মা সেতু চালুর পর সেই চিত্র একেবারেই পাল্টে গেছে। এ প্রকল্পের মেয়াদ আছে আগামী ২০২৫ সাল পর্যন্ত। তবে প্রকল্পটি পরিবর্তন করে ড্রেজিং প্রকল্পে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব ছিল আমাদের। এ নিয়ে ঢাকা-বরিশালে দফায় দফায় বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু কোনো বৈঠকই ফলপ্রসূ হয়নি, কেননা এটি বিশ্বব্যাংকের প্রজেক্ট। এটি বাস্তবায়ন না হলে পুরো টাকাই ফেরত যাবে। তাই বাধ্য হয়ে নদীবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প শুরু করা হচ্ছে।’ 

বিআইডব্লিউটিএর প্রকৌশল বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এএইচএম ফরহাদউজ্জামান বলেন, ‘পদ্মা সেতুর প্রভাবে লঞ্চে যাত্রী কমেছে এটা সত্যি। তবে এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। আমরা আশা করছি ভবিষ্যতে নৌপথের সেই জৌলুস আবার ফিরে আসবে। কেননা এখন যে জনসংখ্যা তা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। তখন হয়তো সড়কপথে তা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। আর সড়কপথের পাশাপাশি নৌ-পথকে টিকিয়ে রাখতে এবং জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেই সরকার এমন উদ্যোগ নিয়েছে।’ 

এদিকে প্রকল্প অনুযায়ী ঢাকা নন্দীবন্দরের যাত্রী চাপ কমাতে বুড়িগঙ্গার তীরে পোস্তগোলা শ্মশানঘাটে একটি নতুন যাত্রী টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। যেখানে থাকবে আধুনিক সব সুবিধা। নতুন টার্মিনালসহ বাকি তিনটি এবং অন্যান্য টার্মিনাল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৩৪৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক দেবে ৩ হাজার ৫২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বাকি ২৯৬ কোটি টাকা দেবে সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। 

সংশ্লিষ্টরা অবশ্য বলছেন, যে বাস্তবতায় ২০১৬ সালে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর তা এখন পুরোটাই বদলে গেছে। সদরঘাটে নেই যাত্রীর চাপ। চাঁদপুর-ভোলার লঞ্চগুলোয় কিছু যাত্রী হলেও বরিশালের যাত্রী একেবারেই কমে গেছে। লঞ্চ মালিকরা জানিয়েছেন, সেতু চালুর আগে প্রতিদিন রাত ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত অন্তত ২৫-৩০টি দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চ ছেড়ে যেত। এখন যাত্রী এতই কমেছে যে বর্তমানে দৈনিক মাত্র চারটি লঞ্চ ছেড়ে যাচ্ছে বরিশালের উদ্দেশে। যাত্রী সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়ায় মালিকরা লঞ্চ বন্ধ করে দিচ্ছেন। লঞ্চ কেটে স্ক্র্যাপ আকারে বিক্রিও করে দিচ্ছেন অনেকে। পাশাপাশি বিআইডব্লিউটিএ নিজেই অনেকগুলো নৌরুট বন্ধ করে দিয়েছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকল্পটির সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘নতুন টার্মিনালটি নির্মাণের প্রয়োজন আছে না নেই সেটা গত এক বছরের যাত্রীচাপের দিকে তাকালেই পরিষ্কার। টার্মিনালে যাত্রী নেই, লঞ্চে ভিড় নেই, এমন পরিস্থিতিতে নতুন টার্মিনাল বানানো বিলাসিতা ছাড়া আর কী? বলা হচ্ছে, যাত্রী বাড়তে পারে, কিন্তু যাত্রী বাড়ার যৌক্তিকতা আমরা দেখি না। তবে এটা ঠিক নৌপথে পণ্য পরিবহন বাড়বে। সে হিসেবে সদরঘাট ঠিক আছে। কিন্তু যাত্রীবাহী অল্প কয়েকটা লঞ্চের জন্য এত ব্যয়বহুল টার্মিনাল বানানো অযৌক্তিক।’ 

বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমেদ অবশ্য মনে করছেন নতুন টার্মিনাল বানানোর যৌক্তিকতা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের যে জাহাজগুলো আছে সেগুলোর জন্য সদরঘাটে পর্যাপ্ত পন্টুন নেই। তাছাড়া নতুন লঞ্চঘাটে যদি আধুনিক যাত্রীসেবা দেওয়া যায় তাহলে পর্যটনেরও নতুন দুয়ার খুলবে। সবাই তো আর সড়ক পথে যাবে না। যাদের তাড়া নেই তাড়া আয়েশ করে লঞ্চে যাবে। অসুস্থ-বৃদ্ধরাও লঞ্চে যাতায়াত করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সে হিসেবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রী ও লঞ্চ দুটোই বাড়বে।’

শুধু টার্মিনাল নির্মাণ করলেই যথেষ্ট হবে না, এর সঙ্গে সড়ক অবকাঠামোও নির্বিঘ্ন হতে হবে বলে মনে করেন এ লঞ্চ মালিক নেতা। পাশাপাশি মেট্রোরেলের একটি লাইন যেন সদরঘাট পর্যন্ত দেওয়া হয়, সে দাবি জানান তিনি।  

নতুন করে পোস্তগোলার শ্মশানঘাট টার্মিনাল নির্মাণের কী বাস্তবতা আছে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. আইয়ুব আলী বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা হলো বর্তমান সদরঘাটটি মালবাহী এবং নতুন টার্মিনালটি যাত্রীবাহী হিসেবে ব্যবহার করা। যদিও বরিশালের যাত্রী ও লঞ্চ দুটোই কমেছে কিন্তু চাঁদপুর-ভোলাসহ কয়েকটি রুটে এখনো যাত্রী চাহিদা রয়েছে।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫