Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

উদ্বোধনের অপেক্ষায় বঙ্গবন্ধু টানেল

নদীর তলদেশে দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৩, ১৮:০২

নদীর তলদেশে দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের ভেতরের অংশ। ছবি- সংগৃহীত

উদ্বোধনের প্রহর গুনছে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। আগামীকাল শনিবার (২৮ অক্টোবর) টানেলটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে পরদিন (২৯ অক্টোবর) ভোর ৬টা থেকে।

এর মধ্য দিয়ে যোগাযোগে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। এতে চট্টগ্রাম মূল শহরের সঙ্গে সাগর ও বিমানবন্দরের দূরত্ব কমে আসবে। বাঁচবে খরচ এবং সময়। অর্থনীতির গতিপথ আরও গতিশীল করতে এ টানেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 

সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, টানেল নির্মাণকে ঘিরে চট্টগ্রাম শহরকে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ বা ‘এক নগর দুই শহর’-এর মডেলে গড়ে তোলা হবে।

সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, দৈনিক ১৭,২৬০ এবং বছরে ৭৬ লাখ যানবাহন চলাচল করতে পারবে এ পথে। নদীর মধ্য ভাগে কর্ণফুলী সুড়ঙ্গ সড়কটি অবস্থান করবে মাটি থেকে ১৫০ ফুট গভীরে। এর নির্মাণকাজ শেষ করে চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি)। এই সুড়ঙ্গ কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের অঞ্চলকে যুক্ত করবে। এটিই হবে বাংলাদেশের প্রথম টানেল এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশের দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গপথ।

তিনি বলেন, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলকে আগলে রেখেছে যে কর্ণফুলী, তার বুক চিরে তৈরি হয়েছে ৩.৩১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ। দেশের এ প্রবেশদ্বারে ব্যবসা-বাণিজ্যের ভিত্তি আরও মজবুত করতে আলাদা শক্তি জোগাবে এই টানেল। বাণিজ্যিক এই রাজধানীতে আরও স্থাপন হবে নতুন নতুন শিল্প ও কলকারখানা, পরিধি বাড়বে আমদানি-রপ্তানির, গতি পাবে অর্থনীতি। সমৃদ্ধির অধিগম্যতায় প্রবেশ করবে চট্টগ্রাম।

কাদের বলেন, টানেলটি চালুর পর চট্টগ্রাম মূল শহরের সঙ্গে সাগর ও বিমানবন্দরেরও দূরত্ব কমে আসবে। অর্থনীতির গতিপথ আরও গতিশীল করতে এই টানেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেল ঘিরে নদীর দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা, কর্ণফুলী, পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে এই উপজেলায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ শুরু হয়েছে।

টানেলে টোলের হার

বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য গত আগস্টে টোল হার চূড়ান্ত করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ। টানেলের মধ্য দিয়ে যেতে হলে ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেট কার), জিপ ও পিকআপকে দিতে হবে ২০০ টাকা করে। আর মাইক্রোবাসের জন্য দিতে হবে ২৫০ টাকা। ৩১ বা এর চেয়ে কম আসনের বাসের জন্য ৩০০ এবং ৩২ বা তার চেয়ে বেশি আসনের জন্য ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে।

টানেলে দিয়ে যেতে হলে ৫ টন পর্যন্ত ট্রাককে ৪০০ টাকা, ৫.১ টন থেকে ৮ টনের ট্রাককে ৫০০, ৮.১ টন থেকে ১১ টনের ট্রাককে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে। তিন এক্সেলবিশিষ্ট ট্রাক-ট্রেইলরের টোল চূড়ান্ত করা হয়েছে ৮০০ টাকা। চার এক্সেলের ট্রাক-ট্রেইলরকে দিতে হবে ১,০০০ টাকা। এর বেশি ওজনের ট্রাক-ট্রেইলরকে প্রতি এক্সেলের জন্য ২০০ টাকা করে অতিরিক্ত দিতে হবে।

৩,৫০০ শ্রমিকের শ্রম-ঘাম

দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নদীর তলদেশের টানেলটি নির্মাণ করতে চীন ও বাংলাদেশ মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। তাদের ঘামে-শ্রমেই অসাধ্য সাধন করেছে বাংলাদেশ।

প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ বলেন, আমরা সেতু বিভাগের প্রকৌশলী থেকে কর্মকর্তারা তো ছিলামই, কিন্তু গত ছয় বছর ধরে শ্রমিকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। প্রথমদিকে প্রায় ২,৫০০ জন শ্রমিক এখানে কাজ করেছেন। শেষের দিকে চীনের আরও ৭ থেকে ৮০০ শ্রমিক যুক্ত করা হয়। যখন যেরকম প্রয়োজন ছিল, সেভাবেই শ্রমিক কাজ করেছে। গড়ে চাইনিজ-বাংলাদেশি মিলে ৩,৫০০ জনের মতো শ্রমিক ছিলেন।

লাইফটাইম ১০০ বছর

হারুনুর রশীদ জানান, লাইফটাইম ১০০ বছর ধরে প্রণীত নকশায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। এটি ১০০ বছর লাইফটাইমের গ্যারান্টি। প্রথম পাঁচ বছর চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন্স লিমিটেডের অপারেশন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে। এর মধ্যে আমাদের প্রকৌশলীসহ কর্মীরা এটা পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ পাবেন।

তিনি বলেন, আমরা চাইব যে, আগামী পাঁচ বছরে আমরা নিজেরাই যেন টানেলের অপারেশন ও ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা অর্জন করতে পারি।

দুর্ঘটনা রোধে অত্যাধুনিক ব্যবস্থা

হারুনুর রশীদ বলেন, টানেলের ভেতর পথ হারানোর কোনো সুযোগই নেই। সেফটি-সিকিউরিটির বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা মহড়াও করেছি। টানেলের ভেতরে কোনো বাস-ট্রাক অথবা অন্য কোনো গাড়ি বিকল হলে কিংবা আগুনও যদি ধরে যায়, সেটা পাঁচ মিনিটের মধ্যে উদ্ধার হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে সব প্রস্তুতি আমাদের আছে। ১০০ সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। মুহূর্তের মধ্যেই সব তথ্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পৌঁছে যাবে।

বিদ্যুৎ বিভ্রাটের বিষয়ে তিনি বলেন, টানেলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলে, আমাদের ট্রান্সফরমার আছে, জেনারেটর আছে। জেনারেটরের সাহায্যে চলবে। এর মধ্যে ইউপিএসও আছে। কারেন্ট যদি চলে যায়, জেনারেটর চালু হতে যে সময়টুকু লাগবে সেই সময়টুকু ইউপিএস চালাবে। তার মানে টানেলের মধ্যে কেউ থাকা অবস্থায় যদি বিদ্যুৎ চলে যায়, সে বুঝতেও পারবে না। এতটুকু বোঝা যাবে যে, আগে হয়তো ১০টি লাইট জ্বলত, এখন চারটি লাইট জ্বলছে। এটা কিছু সময়ের জন্য। সেটা হতে পারে ১০ থেকে ২০ সেকেন্ডের জন্য।

যেভাবে বাস্তবায়িত হলো

কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে চীনের সাংহাই সিটির আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তুলতে টানেল প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এর আগে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম টানেল টিউব নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়েই মূল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়।

টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ১০,৬৮৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে সরকার অর্থসহায়তা দেয় ৪,৬১৯ কোটি টাকা ও চায়না এক্সিম ব্যাংক থেকে সহায়তা নেওয়া হয় ৬,০৭০ কোটি টাকা।

নির্মাণকাজ করেছে চীনা কোম্পানি ‘চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড’। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ৩.৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই টানেলে প্রতিটি টিউব বা সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২.৪৫ কিলোমিটার। একটির সঙ্গে অপর টিউবের দূরত্ব ১২ মিটারের মতো। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেইন তৈরি করা হয়েছে। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে থাকছে ৫.৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এছাড়া ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ওভারব্রিজ রয়েছে আনোয়ারা প্রান্তে।

৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার টানেলে দুটি টিউব দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে। টানেলের উত্তরে নগরীর দিকে আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কাটগড় সড়ক, বিমানবন্দর সড়ক এবং পতেঙ্গা বিচ সড়ক দিয়ে টানেলে প্রবেশ করা যাবে।

এই টানেল দিয়ে যানবাহন ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে চলবে। প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী, টানেলটি প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করবে এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫